নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনকাল মাত্র ৫২ বছরের-১৯১৮ থেকে ১৯৭০ সাল। এর মধ্যে। সক্রিয় সাহিত্যরচনায় ব্যয়িত হয়েছে ৩২ বছর। উপন্যাস, গল্প, কিশাের সাহিত্য, ছােটগল্প, সাহিত্য সমালােচনা-এই চার ক্ষেত্রে তিনি জীবনকালে যথার্থই আলাে ছড়িয়েছেন সর্বদাই। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাই বলেছিলেন, “নারায়ণ সেই বিরল সাহিত্যিকদের একজন, যাদের সাহিত্য। সৃষ্টিকে ভাগ ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন খােপে লেবেল এঁটে দেওয়া যায় না। এদের বুঝতে, বিচার। করতে হয় সৃষ্টির সমগ্রতায়। নারায়ণের সম্পূর্ণ সাহিত্য সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে না দেখলে তার কোনাে দিকের খপ্রকাশের যথার্থ বিচার সম্ভব নয়।” | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম 'পাশাপাশি'। প্রথম গল্পগ্রন্থ 'বীতংস' প্রকাশিত হয় (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে)। পরবর্তী গল্প-সংকলনগুলাে হলাে-'ভাঙাবন্দর' (১৯৪৫), কালাবদর' (১৯৪৮), শ্রেষ্ঠগল্প' (১৯৫১), শ্বেতকমল' (১৯৫১), “গন্ধরাজ' (১৯৫৭), ‘গল্পসংগ্রহ' (১৯৫৭), 'চারমূর্তি' (১৯৫৭), “দুঃশাসন' (১৯৫৬), “উর্বশী' (১৯৫৬), ‘ভাটিয়ালী' (১৯৫৭), জন্মান্তর' (১৯৬০), বনজ্যোৎস্না' (১৯৬০), ভােগবতী' (১৯৬০), ‘শুভক্ষণ' (১৯৬০), “শিলাবতী' (১৯৬৪) প্রভৃতি। তার এই অজস্র গল্পের বক্তব্য ও ভাববৈচিত্র্য, গঠনকৌশল, শিল্পগুণ, পর্যায়ক্রম এবং পরিধির বিস্তার নিয়ে এখনও যথেষ্ট অভিনিবেশ দরকার। | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পকার সত্তার বিশ্লেষণে জনৈকা সমালােচক লিখেছেন, "এই মানবপ্রেমী দরদী লেখকের কলম মানুষের জীবনের, সমাজের সর্বস্তরের আলোআঁধারিকে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী অথচ মরমী স্পর্শে তুলে ধরেছে। মানুষের সরলতা, দুর্বলতা, মমতা, হিংস্রতা, মুখােশের আড়ালে লােভের দৈন্যের, নিষ্ঠুরতার, কুশ্রীতার ছবি আমাদের চমকে দিয়েছে-'টোপ', নক্ৰচরিত', 'দুঃশাসন, বীতংস', ‘পুস্করা' ইত্যাদি গল্পে।... দেখার তির্যক আলােয় মানবচরিত্রের অকল্পনীয় উন্মোচনের নিপুণ স্বাক্ষর তার বহুবিধ গল্পে, জীবনের কটু কথায় রূপ ফুটে উঠেছে সেখানে। আবার অনেক চরিত্রের পতন নিয়তির মধ্যেও পাই উত্তরণের ইঙ্গিত। অন্ধকার তাঁর লেখার শেষ কথা নয়। তিনি আশাবাদী, আলোয় উত্তরণই তার শিল্পীস্বপ্ন। মহাযুদ্ধ আর মন্বন্তরের পটভূমিতে তাঁর লেখকসত্তার বিকাশ তার সাহিত্যে শিল্প কুশলতার উচ্চতর উৎকর্ষের সঙ্গে স্পষ্টোচ্চারিত লেখকের ধিক্কার, ক্রোধ । যুগের ক্রোধ এই যুগশিল্পীর কলমে অসংখ্য সৃষ্টিতে উদ্দীপিত।"