স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না । কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ, যাহা-কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই । সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়ােকে ছােটো করে, ছােটোকে বড়াে করিয়া তােলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত, তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয় । এইরূপে জীবনের বাহিরের দিকে ঘটনার ধারা চলিয়াছে, আর ভিতরের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকা চলিতেছে ।
দুয়ের মধ্যে যােগ আছে, অথচ দু’ই ঠিক এক নহে। আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালাে করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি । কিন্তু, ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগােচরে পড়িয়া থাকে । যে-চিত্রকর অনবরত আঁকিতেছে, সে যে কেন আঁকিতেছে, তাহার আঁকা যখন শেষ হইবে তখন এই ছবিগুলি যে কোন্ চিত্রশালায় টাঙাইয়া রাখা হইবে, তাহা কে বলিতে পারে । কয়েক বৎসর পূর্বে একদিন কেহ আমাকে আমার জীবনের ঘটনা জিজ্ঞাসা করাতে, একবার এই ছবির ঘরে খবর লইতে গিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, জীবনবৃত্তান্তের দুই-চারিটা মােটামুটি উপকরণ সংগ্রহ করিয়া ক্ষান্ত হইব ।
কিন্তু, দ্বার খুলিয়া দেখিতে পাইলাম, জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে- তাহা কোন-এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা । তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রঙ পড়িয়াছে তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে-সে-রঙ তাহার নিজের ভাণ্ডারের, সে-রঙ তাহাকে নিজের রসে গুলিয়া লইতে হইয়াছে; সুতরাং পটের উপর যে-ছাপ পড়িয়াছে তাহা আদালতে সাক্ষ্য দিবার কাজে লাগিবে না। এই স্মৃতির ভাণ্ডারে অত্যন্ত যথাযথরূপে ইতিহাসসংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে কিন্তু ছবি দেখার একটা নেশা আছে, সেই নেশা আমাকে পাইয়া বসিল। যখন পাথক যে-পথটাতে চলিতেছে বা যে-পান্থশালায় বাস করিতেছে, তখন সে-পথ বা সে-পান্থশালা তাহার কাছে ছবি নহে; তখন তাহা অত্যন্ত বেশি প্রয়ােজনীয় এবং অত্যন্ত অধিক প্রত্যক্ষ ।
যখন প্রয়ােজন চুকিয়াছে, যখন পথিক তাহা পার হইয়া আসিয়াছে, তখনই তাহা ছবি হইয়া দেখা দেয়। জীবনের প্রভাতে যে-সকল শহর এবং মাঠ, নদী এবং পাহাড়ের ভিতর দিয়া চলিতে হইয়াছে, অপরাহ্নে বিশ্রামশালায় প্রবেশের পূর্বে যখন তাহার দিকে ফিরিয়া তাকানাে যায়, তখন আসন্ন দিবাবসানের আলােকে সমস্তটা ছবি হইয়া চোখে পড়ে । পিছন ফিরিয়া সেই ছবি দেখার অবসর যখন ঘটিল, সেদিকে একবার যখন তাকাইলাম, তখন তাহাতেই মন নিবিষ্ট হইয়া গেল। মনের মধ্যে যে-ঔৎসক্য জন্মিল তাহা কি কেবলমাত্র নিজের অতীত-জীবনের প্রতি স্বাভাবিক মমত্ব-জনিত । অবশ্য, মমতা কিছু না থাকিয়া যায় না, কিন্তু ছবি বলিয়াই ছবিরও একটা আকর্ষণ আছে ।
উত্তররামচরিতের প্রথম অঙ্কে সীতার চিত্তবিনােদনের জন্য লক্ষ্মণ যে-ছবিগুলি তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহাদের সঙ্গে সীতার জীবনের যােগ ছিল বলিয়াই যে তাহারা মনােহর, তাহা সম্পূর্ণ সত্য নহে। এই স্মৃতির মধ্যে এমন কিছুই নাই যাহা, চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার যােগ্য। কিন্তু, বিষয়ের মর্যাদার উপরেই যে সাহিত্যের নির্ভর তাহা নহে; যাহা ভালাে করিয়া অনুভব করিয়াছি তাহাকে অনুভবগম্য করিয়া তুলিতে পারিলেই, মানুষের কাছে তাহার আদর আছে। নিজের স্মৃতির মধ্যে যাহা চিত্ররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাকে কথার মধ্যে ফুটাইতে পারিলেই তাহা সাহিত্যে স্থান পাইবার যােগ্য ।। এই স্মৃতিচিত্রগুলিও সেইরূপ সাহিত্যের সামগ্রী। ইহাকে জীবনবৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হিসাবে গণ্য করিলে ভুল করা হইবে। সে-হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং অনাবশ্যক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জীবনস্মৃতি এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 160.00 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। Jibonsmriti by Rabindranath Tagoreis now available in boiferry for only 160.00 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.