নীচৈতন্যচরিতামৃত একাধারে ভগবান ও ভক্তের মুখোমুখি কথোপকথনে বৈষ্ণব সাধনতত্ত্বের, রসদর্শনের, আদর্শ মানবচরিত্র গঠনের এবং চিত্তশুদ্ধির বঙ্গাক্ষরে কবিরাজ কৃষ্ণদাসের সমন্বয়মুখী সার্বভৌম সৰ্ব্বজনীন মহাগ্রন্থ ।
মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসাহিত্যকুঞ্জে কবিরাজ কৃষ্ণদাসের পয়ার ত্রিপদী অনাবিল রাসমাধুৰ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ। এই মহাগ্রন্থটি 'চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়' বৌদ্ধসাধনের গোপন ইঙ্গিতবাহী মাতৃভাষার ধ্বনিলাবণ্যসংযুক্ত মন্ত্রাত্মক গ্রন্থ। বাংলাভাষার উন্মেষের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটিকে ভাষার জাগরণের অরুণোদয়ের ঊষালগ্ন বলা যায়। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে এই ভাষার ছায়াপাত শব্দসজ্জায় কিছু কিছু প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই।
শব্দব্যুৎপত্তি, শব্দশক্তি, ধ্বনির সুরলাবণ্য, ভগবদ্ সেবালালসা, উৎকণ্ঠিত চিত্তের আত্মনিবেদনের অশ্রুসজল পদপদাবলির সুচারু নির্মিতির নির্মোহ অভিলাষের সংজ্ঞার ললিত ব্যাখ্যা, অলৌকিক বৈষ্ণবীয় ভাবসাধনার সুনির্বাচিত শব্দাবলির মাধ্যমে অধিকার মাল্য নির্মাণপটু আভিধানিক গবেষক শ্রীনন্দলাল শর্মা মহোদয়ের সূক্ষ্ম রসবোধ ও পরম্পরার সংরক্ষণ গৌরবকে অক্ষুণ্ণ প্রসন্নতার ধারাকে রসব্রহ্মতত্ত্ব, লীলাবিনোদ ভগাবান ও পরমাত্মা এই ত্রয়ীর রহস্য ব্যাখ্যায় এক অনন্যদুর্লভ প্রতিভার কিরণচ্ছটায় আমরা বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হইয়া থাকি। পূজ্যপাদ কৃষ্ণদাসের সেকালে সংরক্ষণের মানসিকতায় দুরূহ পুথিশালার গোস্বামিবর্গের গ্রন্থাবলি হইতে সম্বন্ধ, অভিধেয়, ভোজন, ঈশ্বরতত্ত্ব, লীলাবাদ, ভক্তের আচারবিধি, মূর্ত ও অমূর্ত স্বরূপবিশ্লেষণে সতর্ক সভার নিপুণতার দক্ষতা দেখিয়া স্তম্ভিত হইতে হয়। জীবের ভগবদ্ উপাসনার নিষ্ঠাস্নিগ্ধ হৃদয়ের দৃঢ় প্রত্যয়যুক্ত শঙ্খনির্ঘোষের ন্যায় আজও পয়াররাজি জীবন্ত ও সাধনজীবনের নিত্যসঙ্গী। এই ভাবনার প্রত্যয়শীল মননের পুষ্পিত উদ্যানে অভিসারলুব্ধ মহান গ্রন্থকারের অন্তরে ভাবশুচিস্নিগ্ধ এই পুণ্য আয়োজনকে অভ্যর্থিত করি। ভাষাবিজ্ঞান সচেতনতা, শব্দার্থ নির্ণয়ের নিরলস অন্বেষাবৃত্তি, উপমা সৌন্দর্য অনুভবের সংস্কারপ্রিয়তা গ্রন্থকার মহোদয়ের স্বভাবধর্মের কুণ্ঠাহীন সাত্ত্বিক ভাবোজ্জ্বল রূপটি আমাদের সমীপে প্রকটিত হইয়াছে।