শরৎচন্দ্রের বিদ্রোহাত্মক চিন্তার এক আশ্চর্য পরিণতি দেখা যায় শেষ জীবনের কয়েকখানি বইতে- 'চরিত্রহীন', 'গৃহদাহ', 'শেষপ্রশ্ন' এবং 'শ্রীকান্তের মধ্যে। অবশ্য 'চরিত্রহীন' বইখানি এককালে যথেষ্ট আলাড়ন সৃষ্টি করে থাকলেও আসলে এতে যে বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেয়েছে বিধবার প্রেম- বাংলা সাহিত্যে তা নতুন নয়। তবে কিরন্ময়ী চরিত্রটি একটি দুঃসাহসিক সৃষ্টি। লেখক এ বইতে এ কথাই প্রতিপন্ন করেছেন যে যৌবন- অনুত্তীর্ণা বিধবার প্রেম করার নিশ্চয়ই অধিকার আছে যদি তার প্রেমে স্বার্থহীন সেবার মনােভাব ও নিষ্ঠা থাকে। সাবিত্রী চরিত্রটির মধ্যে এই মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। কিরন্ময়ীর মতাে যে-নারীর নিষ্ঠা অনিশ্চিত লেখক তাকে সমর্থন করেননি। লেখক কিন্তু সাবিত্রীর সঙ্গে সতীশের বিবাহের ব্যবস্থা দিতে পারেননি। তা যাতে না দিতে হয় সেই জন্য সরােজিনী চরিত্রটিকে উপস্থিত করেছেন। কিরন্ময়ীর মতাে ‘গৃহদাহের অচলাও লেখকের পূর্ণ সমর্থন পায়নি। প্রেমে একনিষ্ঠা সাধারণত কাম্য হলেও সেটাকে একটি অপরিবর্তনীয় নিয়ম বলে গ্রহণ করা যায় কিনা গ্রন্থে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। অচলার সামনে দুই পুরুষ এসে উপস্থিত হয়েছিল। 'ঘরে বাইরে'র নিখিলেশের মতাে মহিম শান্ত ধীর কর্তব্যনিষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ, এবং সন্দীপের মতাে সুরেশ অশান্ত উদ্বেল জীবনী শক্তিতে ভরপুর। মহিমকে অচলা ভক্তি করে তার চরিত্রমাহাত্মাের জন্য; কি সুরেশের প্রাণচাঞ্চল্য তাকে দুর্বার বেগে আকর্ষণ করে। এবং যেহেতু ভক্তি এবং জৈব আকর্ষণ এই উভয় পথেই নারীর প্রেম জাগ্রত হয়, অচলা পর্যঅয়ক্রমে উভয়কেই ভালবাসে এবং একজনের উপর চূড়ান্তভাবে মনােনিবেশ করতে পারে না। লেখক সযত্নে এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে চিত্রিত করেছেন; মহিমকে বিয়ের পর অচলা যে মহিমের বাড়ি ছেড়ে সুরেশের সঙ্গে চলে | গেল তারও সঙ্গত পরিবেশ রচনা করেছেন। মহিমের শীতলতা, একঘেয়ে গ্রাম্য পরিবেশ যে অচলার মতাে নারীর কাছে কারাগারের মতাে লেখক তা দেখিয়েছেন।