মুক্তিযুদ্ধের সবগুলাে গল্পই জৌকুড়া গ্রামের পটভূমিকায় রচিত। যুদ্ধের শুরুতে আমরা রাজবাড়ি থেকে পালিয়ে নিকটবর্তী জৌকুড়া গ্রামে চলে যাই। সেখানে দাদুবাড়িতে অতিবাহিত হয় যুদ্ধের নয় মাস। আব্বা ছিলেন রাজবাড়ি থানার (তকালীন) অন্যতম রাজনৈতিক নেতা। ফলে পালিয়ে গিয়েও আমরা নিস্তার পেলাম না। বিহারীরা রাজবাড়ি থেকে এসে আমাদের বাড়ী লুট করলাে। সেদিন আব্বা অল্পের জন্য বেঁচে যান। জৌকুড়া গ্রাম তার জন্য বিপদজনক হয়ে উঠলাে। বাড়ি লুটের তিনদিন পর আব্বা পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেলেন। তারপর বহুদিন আব্বার কোন খোজখবর পাইনি। সে সময় এক দুর্বিসহ অভাবের ভেতর আমাদের দিন কাটছিলাে। একবেলা গমের জাউ বেঁধে দুবেলা খেতাম। সকালবেলা উপােস দিতে হতাে। তার উপর ছিলাে প্রতিনিয়ত রাজাকারদের মৃত্যুহুমকি। কত রাত যে বিহারী আর রাজাকারদের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। গা ছম ছম সেসব দিনের কথা মনে হলে আজো গায়ের লােম খাড়া হয়ে ওঠে। প্রায় মাস দুইয়েক পর একদিন পিয়ন দিয়ে গেলাে বাবার চিঠি। ভারত থেকে ভায়া লন্ডন হয়ে বাবা চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে জেনেছিলাম, বাবা আছেন ভারতের বসিরহাটের এক সরণার্থী ক্যাম্পের দায়িত্বশীল কাজে নিয়ােজিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের বাবা এক অকুতােভয় সৈনিক-ভভাবতেই গর্বে আর অপরিসীম আনন্দে বুকটা ভরে উঠেছিলাে। সে খুশীর ছটা লিখে প্রকাশ। করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম যত অগ্রসর হতে লাগলাে, ততই জৌকুড়া গ্রামে। মুক্তিযােদ্ধাদের আনাগােনা লক্ষ্য করতে লাগলাম। প্রথম যেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের চাক্ষুষ দেখলাম, সেদিন বিস্ময়ে আমার চোখের পলক পড়ছিলাে না। একদিন বীর মুক্তিযােদ্ধারা দুমাইল দূরবর্তী বারাইজুরি গ্রামের রেলওয়ে ব্রিজ পুড়িয়ে দিলেন। খান সেনাদের রাজবাড়ির সঙ্গে খুলনার রেলওয়ে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাে। মুক্তিযােদ্ধাদের চৌকস সাফল্যে। জৌকুড়া গ্রামে এক উদ্দীপনার সাড়া পড়ে গেলাে।