উপন্যাসের পত্রবিনিময়ের মধ্যে যেসব ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঘটনার উল্লেখ আছে তা উপন্যাসটিকে বিশ্বাসযােগ্য করে তােলে। আজকের ইরাক আর পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে বাংলা পর্যন্ত উঠে এসেছে উপন্যাসে। তাই বাগদাদ থেকে করাচি সেনানিবাস আর বাঁকুড়া সবই যেন পাঠক মনশ্চক্ষে অবলােকন করতে পারেন। এরই মধ্যে নূরুল হুদার আত্মােঘাটন- অন্যান্য চরিত্রের চুম্বক প্রকাশ- অসাধারণ বায়তায় নজরুল রচনা করেছেন এই ভিন্ন ধরনের উপন্যাস। নূরুল হুদা আর নজরুল ইসলাম কি একই জন? নজরুল নিজের চরিত্রের ছাপে সৃষ্টি করেছেন উপন্যাসের চরিত্র? হবে পরেন; লম্বা চুল রাখেন। অন্তরঙ্গেও মিল: দুজনেই খানিকটা খেয়ালি; কবিস্বভাব সম্পন্ন; বিয়ের মতাে ‘সিরিয়াস' বিষয়ে হঠাৎ প্রতিকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ। প্রেমের ক্ষেত্রে একাধিক নারীর প্রতি আগ্রহের ব্যাপারটি না-হয় উহ্যই থাকলাে! তাই যদি এভাবে বলি: নজরুল ইসলাম নিজের চরিত্রের স্বরূপ উঘাটনের জন্য উপন্যাসে নুরুল হুদাকে ব্যবহার করেছেন- সত্যি কি ভুল বলা হবে? নূরুল হুদা নজরুল চরিত্রের প্রতিরূপ, একথাও বলা চলে। নজরুল নূরুল হুদার মাধ্যমে নিজের জীবনের অবিকশিত প্রেমের কথাগুলােকে বলবার চেষ্টা করেছেন- মনুয়র, রবিয়ল, সাহসিকা ও রাবেয়ার পত্রের মাধ্যমে নিজের অশান্ত ব্যক্তিসত্তার স্বরূপ উঘাটনের চেষ্টা করেছেন। উপন্যাসে নূরুল হুদার মধ্যে রােমান্টিক ভাব, কল্পনা ও বিভাবনার বহুবর্ণিলতা লক্ষ করা যায়। আর বাঁধন-হারা' নামের মধ্যেওতাে সে রােমান্টিক ভাবাদর্শের পরিচয় আছে। পত্রগুলােতে নূরুল হুদার রােমান্টিক ভাব, কল্পনা ও বিভাবনার বহুবর্ণিলতা পাশাপাশি অন্তর্যাতনাও লক্ষ্যণীয়। আর সাহসিকার পত্রে নূরুল হুদার সে যাতনার পরিচয় পাওয়া যায়। আর মানবতা ও মানবাত্মার মুক্তি বেদনার জন্য নজরুলের যাতনা পত্রগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। সাহসিকা রাবেয়াকে পত্রে যেভাবে লিখেছে, সেটাই বােধ হয় নূরুল হুদার আসল পরিচয়। সাহসিকা রাবেয়াকে লিখেছে, এটা ভুলিসনে যেন রেবা যে, এ-ছেলে বাঙলাতে জন্ম নিলেও বেদুঈনদের দুরন্ত মুক্তি-পাগলামি, আরবিদের মস্ত গাের্দা, আর তুর্কিদের রক্ত-তৃষা ভীম স্রোতাবেগের মত ছুটছে এর ধমনীতে ধমনীতে।' এই পরিপ্রেক্ষিতেই সাহসিকার কথায় নূরুল হুদার প্রকৃত পরিচয় সন্ধান করা যায় । এভাবে- নূরুল হুদা সম্পর্কে সাহসিকার ভাষ্য: ‘পাগলা হাতি আর উদোম ষাঁড়কে জিঞ্জির বা দড়াদড়ি দিয়ে বাঁধলে হয় তারা বাঁধন ছিড়বে, নয় আছাড় খেয়ে খেয়ে মরে বন্ধনমুক্ত হবেই হবে। আর যদিই ব্যতিক্রম স্বরূপ বেঁচে যায়, তবে সে বাঁচা নয়, সে হচ্ছে জীয়ন্তে-মরা। মুক্ত আকাশের পাখিকে সােনার শিকল, মণি| মানিক্যের দাঁড়, দুধ-ছােলা দেখিয়ে হয় তাে প্রলুব্ধ করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু | তাতে কেউ বেঁধে রাখতে তাে পারবে না। সেও অমনি করে বন্ধনমুক্ত হবেই।