“ঘরে বাইরে” রচনার প্রায় বার বৎসর পর রবীন্দ্রনাথ আবার উপন্যাস লিখিলেন। এই উপন্যাসের প্রথম নামকরণ হইয়াছিল “তিনপুরুষ”। এই নামে “বিচিত্রা” মাসিকপত্রে আশ্বিন ও কার্তিক এই দুইমাস বাহির হইবার পর কবি পুরাতন নাম বদল করিয়া ইহার নূতন নামকরণ করেন “যােগাযােগ”। এই নূতন নামকরণ উপলক্ষে লেখক একটি সুদীর্ঘ কৈফিয়ৎ দিয়াছিলেন। এই কৈফিয়তের কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করা প্রয়ােজন। হইল। কবি বলিলেন, সাহিত্যসৃষ্টিতে। | “আখ্যান বস্তু, রচনারীতি, চরিত্রচিত্র, ভাষা, ছন্দ, ব্যঞ্জনা, নাট্যরস সবটা মিলিয়ে একটি সমগ্র বস্তু। একেই বলা চলে ব্যক্তিরূপ। বিষয়ের কাছ থেকে সংবাদ পাই, ব্যক্তির কাছ থেকে তার আত্মপ্রকাশজনিত রস পাই। বিষয়কে বিশেষণের দ্বারা মনে বাঁধি, ব্যক্তিকে সম্বােধনের দ্বারা মনে রাখি। রসশাস্ত্রে মূর্তিটি মাটির চেয়ে বেশি, গল্পটিও বিষয়ের চেয়ে বড়াে। এই জন্যে বিষয়টাকে শিরােধার্য করে নিয়ে গল্পের নাম দিতে আমার মন চায় না। গল্প জিনিসটাও রূপ, ইংরেজীতে যাকে বলে ক্রিয়েশন’; আমি তাই বলি গল্পের এমন নাম দেওয়া উচিত নয় যেটা সংজ্ঞা; আর্থাৎ যেটাতে রূপের চেয়ে বস্তুটাই নির্দিষ্ট। বিষবৃক্ষ' নামটাতে আমি আপত্তি করি। কৃষ্ণকান্তের উইল’ নামে দোষ নাই! কেননা ও নামে গল্পের কোন ব্যাখ্যাই করা হয়নি। কর্তা বলেন, তিনপুরুষের তিন তােরণওয়ালা রাস্তা দিয়ে গল্পটা চলে আসবে এই আমার একটি খেয়াল মাত্র ছিল। এই চলাটা কিছুই প্রমাণ করবার জন্য নয়, নিছক ভ্রমণ করবার জন্যেই। সুতরাং এই নামটা ত্যাগ করলে আমার গল্পের কোন স্বত্বের দলিল কাঁচবে না। আর একটি নাম ঠাউরেছি। সেটা এতই নির্বিশেষ যে গল্প মাত্রেই নির্বিচারে খাটতে পারে (“বিচিত্রা” অগ্রহায়ণ, ১৩৩৪, ৮৯-৯১ পৃ.)।
সাধারণভাবে এই যুক্তিকে স্বীকার করিতে আমার কোনও আপত্তি নাই; নাম, নাম মাত্রই, তাহার সঙ্গে বিষয়বস্তুর যােগ থাকিতেই হইবে, এমন কোনও যুক্তি নাই, বরং না থাকাটাই সুবিধাজনক। সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যাখ্যাবাহী নাম বন্ধনেরই নামান্তর। কিন্তু “তিন পুরুষ” নামটি যখন “যােগাযোেগ” উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করা যায়, তখন মনে হয় গল্পবস্তুটির রূপ ও প্রসার সম্বন্ধে গােড়ায় লেখকের মনে যে ধ্যান ছিল সেই ধ্যানের সঙ্গে “তিন পুরুষ” নামের একটা সার্থক যােগ ছিল। কিন্তু সেই ধ্যান “যােগাযােগ” পরিপূর্ণতা লাভ করে নাই; গল্পবস্তুর রূপ ও প্রসার সম্বন্ধে যে পরিকল্পনা ঘােষালের বত্রিশ বৎসরের জন্মদিন লইয়া গল্পের সূচনা সেই গল্প পিছু হটিয়া যাত্রারম্ভ করিয়াছে অবিনাশের পিতামহ আনন্দ ঘােষালের মুহুরিগিরি হইতে, অর্থাৎ মােটামুটি ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় পাদ হইতে। আনন্দ ঘােষালের জীবনেতিহাস প্রথম পুরুষ, দ্বিতীয় পুরুষ আনন্দ ঘােষালের পুত্র মধুসূদন, তৃতীয় পুরুষ অবিনাশ ঘােষাল। এই তিনের প্রথম পুরুষের সংক্ষেপে এবং দ্বিতীয় পুরুষের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান ও পরিবেশ সবিস্তারে “যােগাযোেগ” বিবৃত হইয়াছে। তৃতীয় পুরুষে অবিনাশ ঘােষালের জন্মের আভাসের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রন্থের পরিসমাপ্তি। কেন জানি মনে হয়, এই তিন জন্মের পুরুষ ধরিয়া বাঙালী সমাজের পারিবারিক জীবনে যে বিবর্তন হইয়াছিল, গ্রন্থপরিকল্পনার সূচনায় এই বিবর্তনের ইতিহাস লেখকের মনের পশ্চাতে ছিল; এই প্রসারিত পটভূমির উপরই তিনি “তিন পুরুষের বিচিত্র চরিত্রগুলির জীবন-লীলা ফুটাইয়া তুলিতে চাইয়াছিলেন। কিন্তু যে কারণেই হউক, “যােগাযােগ” তাহা এত সমগ্রতায় উদ্ঘাটিত হয় নাই। মধুসূদন ও কুমুদিনীর বাল্য ও কিশাের জীবনের পরিবেশ, এবং তাদের যৌবনের দাম্পত্য জীবনের সূক্ষ্ম ও স্থূল লীলাই উপন্যাসটির প্রধান উপজীব্য।
“তিন পুরুষের মূল মনন-কল্পনার মধ্যে মহৎ উপন্যাসের বীজ নিহিত ছিল; সেই মনন-কল্পনা ভিন্নমুখী না হইলে হয়ত “গােরা”র মত আর একটি উপন্যাস সৃষ্টি আমরা প্রত্যক্ষ করিতে পারিতাম। কিন্তু “যােগাযোেগ” বিবর্তিত হইয়া “তিনপুরুষের সে সম্ভাবনা ঘুচিয়া গেল। বস্তুত, “গােরা”-পরবর্তী রবীন্দ্রনাথের সকল উপন্যাসই নভেলধর্মী’, তাহাদের খাটি উপন্যাস বলা একটু কঠিন; একমাত্র “যােগাযােগই তবু উপন্যাসের ধর্ম খানিকটা বজায় আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর যোগাযোগ এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 200.00 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। Jogajog by Rabindranath Tagoreis now available in boiferry for only 200.00 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.