"বাণিজ্য ও বাংলাদেশের জনগণ" বইটির 'গ্রন্থনা প্রসঙ্গে' অংশ থেকে নেয়াঃ
গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হল: এককেন্দ্রিক বিশ্ব কাঠামােয় একটি একক অর্থনৈতিক আদলে দুনিয়াব্যাপী সম্পর্কের পুনর্বিন্যস। সব রাষ্ট্রের সম্পর্কে প্রধানত পুঁজির বৈশ্বিক চলাচল, বিচলন, বিনিয়ােগ ও বিশ্ববাজারের অধীনে সাজানাে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে উন্নয়নশীল স্বল্পোন্নত ইত্যাদি বিভিন্ন পক্ষ বা অর্থনৈতিক জোটের আর্বিভাব সূচিত হয় এরই ধারাবাহিকতায়। প্রয়ােজন, সক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ উপকরণের সুবিধা বিবেচনায় কোন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র আর্থিক পরিকল্পনায় আগেকার জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের ধারণার অবসান ঘােষণা করা হয়। রপ্তানীমুখি উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উন্নয়নের একমাত্র চাবিকাঠি বলে প্রচার করা হয়। তথাকথিত অবাধ বাজারের ভিতর দিয়ে যা অর্জিত হবে বলে সাব্যস্ত হয়। বহুপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের তখন সম্মিলিত প্রয়াস হয়ে দাঁড়ায় একীভূত এবং অভিন্ন শাসনের আওতায় দুনিয়াব্যাপী একটি বাণিজ্য কাঠামাে (trade regime) প্রতিষ্ঠা করা।
ঘটে যাওয়া এসব পরিবর্তন এবং এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে নিয়ে ফরহাদ মজহার নানান সময়ে লিখেছেন। ফলে তার আলােচনা শুধু বাণিজ্যের গত্বাধা তর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্বভাবতই তা আলাে ফেলেছে, রাষ্ট্র, রাজনীতি, পরিবেশ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন-জীবিকার মত সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলাের দিকে। মরােক্কোর মারাকেশ শহরে ১৯৯৪ সালে ১২ থেকে ১৫ এপ্রিল, আয়ােজিত মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় গ্যাটের উরুগুয়ে রাউন্ডের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সভায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) প্রতিষ্ঠার জন্য মারাকেশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে বছরই পাক্ষিক চিন্তা পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্র করেছিল, ‘গ্যাট, বিশ্ব বাণিজ্য ও তৃতীয় বিশ্বম্ব শিরােনামে ৩০ এপ্রিল, ১৯৯৪ তারিখ সংখ্যা।
ফরহাদ মজহারের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এছাড়া একটি খুদে পুস্তিকা ২০০৪ সালে চিন্তা প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছিল। সেটা আর সহজলভ্য নয়। সেগুলাে প্রধানত ছিল মেক্সিকোর কানকুন শহরে ২০০৩ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্যভূক্ত দেশগুলাের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের পঞ্চম সম্মেলনকে ঘিরে, বিশ্ববাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই। শেষ পর্যন্ত কোনপ্রকার সমঝােতা ছাড়াই সেই সম্মেলনের আলােচনা পণ্ড হয়ে যায়। বিশেষ করে কৃষিচুক্তির প্রশ্নে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিরােধের মুখে ধনী দেশগুলাে পিছু হটে। কিন্তু বিশ্ববাণিজ্য, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে ফরহাদ মজহারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লেখা তখন ঐ খুদে পুস্তিকায় গ্রন্থভুক্ত করা হয়নি। যেমন, সিয়াটেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার তৃতীয় মন্ত্রী পর্যায়ের সভা সংক্রান্ত তাঁর লেখালেখি, কিম্বা | তথাকথিত স্বল্পোন্নত দেশগুলাের সম্মেলন নিয়ে নিবন্ধ । তাছাড়া বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির পরেও ধনী দেশগুলাে ক্রমাগত দুর্বল দেশগুলাের ওপর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির জন্য চাপ দিয়ে চলছিল, সেইসব বিষয়ে লেখাগুলােও এর আগে গ্রন্থভূক্ত হয়নি। এখানে এবারই প্রথম গ্রন্থভূক্ত হল।
নব্বই দশকের শুরু থেকেই সারা বিশ্বে গ্লোবালাইজেশান বা গােলােকায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল, বাংলাদেশেও অনেক প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তি সক্রিয়ভারে তার বিরােধিতা করছিলেন। এন্টি-গ্লোবালাইজেশান বা পুঁজিতান্ত্রিক গােলােকায়ন বিরােধী আন্তর্জাতিক সংগ্রাম পুঁজিতান্ত্রিক গােলােকায়ন বা সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নকে এই সময়ের প্রধান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রশ্ন আকারে হাজির করতে পারলেও নানা কারণে এই সংগ্রাম ক্রমে ক্রমে নুইয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পুঁজিতান্ত্রিক গােলােকায়ন বিরােধী প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সংগ্রামের প্রধান অবদান হচ্ছে বাংলাদেশের মত দেশগুলাের জন্য বিশ্ববাণিজ্য চুক্তি ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আসল তাৎপর্য কি সেই দিকগুলাে ব্যাখা করা। এই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণগুলাে ধনী দেশগুলাের সাথে গরিব দেশগুলাের বাণিজ্য নিয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে বটে, কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক গােলােকায়ন ও বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে গরিব দেশ ও জনগণকে যদি লড়ে জিততে হয় তাহলে যে চরিত্রের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশক্তির গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের সীমা ও সম্ভারনা বিকশিত করা দরকার সে দিকটা নিয়ে আলােচনা খুব কমই হয়েছে। আজ অবধি এ দিকটি অস্পষ্ট থেকে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করে একদিকে রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে, অন্যদিকে তাকে রহুপাক্ষিক চুক্তিতে বাংলাদেশের মতাে দেশগুলাে যে ছাড় দিয়ে এসেছে তার চেয়েও রাড়তি ছাড় দেবার জন্য ধনী দেশগুলাে ক্রমাগত হাত মুচড়ে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাে ক্রমাগত তাদের নীতি ও কৌশল বদল করেছে। তার ধাক্কা সামলাবার জন্য বাংলাদেশের মতাে রাষ্ট্রগুলাের পুনর্গঠনের পথ কি? কিভাবে রাষ্ট্রশক্তিকে গণশক্তিতে পরিণত করতে হবে সেই দিকগুলাে পরিবর্তিত এই বাস্তবতার আলােকেই আমাদের ভাবতে হবে।
এটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়া যে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা গঠন করেছে তাতে কাজ হয়নি, ডব্লিওটিও ব্যর্থই হয়েছে বলা চলে। অন্তত সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের বিপর্যয়ের পর তা নিয়ে কেউ খুব একটা আর কথা বলছে না। যেখানে অবাধ রাজারের তত্ত্ব এতােদিন আমাদের গেলানাে হচ্ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে বুলি ও ভােল। পালটে ধনী দেশগুলাে যার যার বাজার সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করেছে। দুনিয়ারাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট আগের চেয়ে অনেক তীব্র হয়েছে এবং সেটা গিয়ে এখন ঠেকেছে সম্ভাব্য মুদ্রা-যুদ্ধে। যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কাঠামােটাইকেই পুরােদস্তুর নড়বড়ে করে দিবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সৃষ্ট সংকটের অনেক আলামত এখন দেখা যাচ্ছে। আইএমএফের সংস্কারের কথা। আলােচনা হচ্ছে জোরেশােরে। জি-২০ সম্মেলন থেকেও কোন সমঝােতা বা সমাধানে পৌঁছানাে যায়নি।
বিশ্ব ব্যবস্থার এরকম একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা। সেই আলােকে ডব্লিওটিও ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির ব্যর্থতার তাৎপর্য কি? এই ব্যর্থতা ধনী দেশগুলাের নিজ নিজ বাজার রক্ষার নানাবিধ কৌশল বা বাজার সংরক্ষণ নীতির মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনি একইভাবে পরস্পরের সাথে তীব্র মুদ্রাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আগামী দিনগুলােতে ক্রমশ আরাে বেশি বেশি স্পষ্ট হবে। শেষতক তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনই বলা মুশকিল।
ফরহাদ মজহার উদার বাজার নীতির বিরুদ্ধে, কিন্তু তার বিপরীতে সংরক্ষণবাদিতারও তিনি সমর্থক নন। আসলে উদার বাজার নীতির মতাদর্শিক মর্ম হচ্ছে অল্পকিছু কর্পোরেশনের ব্যবসার জন্য সব রাষ্ট্রকে পণ্য ও পুঁজির চলাচল ‘অবাধম্ব করে দেওয়ার অন্যায় আবদার। যার পরিণতি দুনিয়ায় অল্পকিছু কর্পোরেশনের হাতে পুঁজির পুঞ্জিভবন ঘটানাে এবং অল্পকিছু বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। অতএব, এই নীতির বিরুদ্ধে পৃথিবীর আরাে অনেক সচেতন রাজনৈতিক ও সমাজ কর্মীর মতাে তিনিও নিরাপােষ লড়ছেন। এই লড়াইয়ের চরিত্র হচ্ছে একদিকে কর্পোরেট গ্লোবালাইজেশান যা সাম্রাজ্যবাদ আর অন্যদিকে দুনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সংগ্রাম। এই বাস্তবতার আলােকেই ফরহাদ মজহার দাবি করেন প্রথাগত ও প্রচলিত রাষ্ট্র আর জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে সক্ষম নয়, নয়া উদারনীতিবাদের যুগে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্ক যে কোন সময়ের তুলনায় আরাে অসহনীয় ও বৈরী হয়ে পড়েছে। গণমানুষকে নিজের প্রতিরক্ষার দিশা, পথ, নীতি ও কৌশল নিজেদেরই সন্ধান করতে হবে। এইকালে টিকে থাকতে হলে জনগােষ্ঠী হিশাবে আমাদের গণপ্রতিরক্ষা ও গণশক্তির উদ্বোধনের দিকে মনােযােগ দিতে হবে। বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা কিম্বা অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্ব এখন কোনটাই আর একটা থেকে অন্যটা আলাদা নয়। এই আলােকে লেখাগুলাে পড়লে পাঠক উপকৃত হবেন আশা করি।
মুসতাইন জহির
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১
ফরহাদ মজহার এর বাণিজ্য ও বাংলাদেশের জনগণ এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 297.50 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। Banijjo O Bangladesher Jonogon by Forhad mojheris now available in boiferry for only 297.50 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.