পলাশী যুদ্ধের পর (১৭৫৭ সালে) বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের এক সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত বয়ে আনে। আবার অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব এবং ফ্রান্সে রক্তক্ষয়ী ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রি.) প্রভাবও এসে পড়ে বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। এ সময়ে বাংলার কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরাই বাংলায় রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সূচনা করেন। ইউরোপীয় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে এই শিক্ষিত বাঙালিদের মনে নবজাগরণের সূচনা হয়। এঁদের নেতৃত্বের প্রভাবে দেশবাসীর মধ্যে আত্মসচেতনতা, আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্রভাবে জাগ্রত হতে থাকে। নবজাগরণের প্রভাবেই শেষ পর্যন্ত বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাথমিক ভিত রচিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত বাঙালিকে তথা ভারতীয়দের স্বাধীনতার পথে ঠেলে দেয়।
এই সময়ে প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, সামাজিক রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে একধরনের চিন্তার বিপ্লব সূচিত হয়। এই পরিণতিতে উদ্ভব ঘটে নতুন ধর্মমত (ব্রাহ্ম ধর্ম ও নব হিন্দুবাদ), নতুন শিক্ষা, নতুন সাহিত্য, নতুন সামাজিক আদর্শ ও রীতি-নীতির। এই নতুনের মধ্যেই বাংলায় ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে। এভাবেই উপমহাদেশে বাংলায় প্রথম নবজাগরণের বা রেনেসাঁর জন্ম। ফলে সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলা হয়ে ওঠে আধুনিক চিন্তা- চেতনার কেন্দ্রস্থল। ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে বাঙালি পরিণত হয় পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহকে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা প্রত্যাখ্যান করে যুক্তিবাদ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে আধুনিক মানুষে পরিণত হন। এই নবভাবধারা প্রসারে ইস্ট-ইন্ডিয়া-কোম্পানির কিছুসংখ্যক উদারচেতা প্রশাসকেরও অবদান রয়েছেন। এরা দেশি ভাষা-সাহিত্যের উন্নতির জন্য প্রবল উৎসাহ দেখিয়েছেন।
হেস্টিংস, অ্যালফিনস্টোন, ম্যালকম মনরো, মেটকাফ প্রমুখ ইংরেজ প্রশাসকের অনেকে ভারতবাসীকে পাশ্চাত্য ভাবধারা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনে উজ্জীবিত করাকে তাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব-কর্তব্য বলে মনে করতেন। তাছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাও আধুনিক শিক্ষার ভাবধারা প্রসারে উলে­খযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়।
ঊনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শন চিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অন্যন্য সমাহার, যা মধ্যযুগের যুগান্তর ঘটিয়ে এ দেশে আধুনিক যুগের সূচনা করে।