উনিশ শতকের বাঙালি মানসের আত্ম-প্রতিষ্ঠার কঠিন কর্মে বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮১৮৯৪) যুক্তিবাদী ভূমিকা এবং সৃজনশীল লেখনী ধারন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সার্থক স্রষ্টারূপে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) প্রথম শিল্পসফল উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ সুবাদে বাংলা গদ্যের বিকাশ সাধনেও বঙ্কিমচন্দ্রের অপরিসীম অবদান রয়েছে। প্রবন্ধ রচনা ও সমালােচনা সাহিত্যেরও পথিকৃৎ প্রবর্তকরূপে গৌরবের অধিকারী হয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবেই বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র সবিশেষ অবস্থান দখল করে আছেন। বাংলা উপন্যাসে তিনি সর্বাঙ্গসুন্দর শিল্পসমবায় ও আন্তর্জাতিক মূল্যমান আরােপ করেছেন। তাঁর উপন্যাসের দেহগঠনের আদর্শ এসেছে ইংরেজি নাটক, বিশেষ করে শেক্সপিয়র থেকে। তাঁর নাটক গড়ার কলাকৌশল কেন্দ্রবদ্ধরূপ, উপকাহিনীর আনুগত্য তথা তাৎপর্য মুখিতা বঙ্কিম গ্রাস করেছিলেন। ইউরােপে নাট্যতরঙ্গিত ভঙ্গিতে যেসব গদ্য উপন্যাস লেখা হত শিল্প বিচারে তাদের মান বিশেষ উঁচুতে ছিল না। বঙ্কিম নাট্যভঙ্গিকে মানবচিত্তের গভীর বােধের সঙ্গে যুক্ত করে উপন্যাস শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরী করলেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শের সমন্বয় ঘটিয়ে তাঁর উপন্যাস শিল্পকে সমৃদ্ধিশালী করেছেন। | বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিপুষ্টিসাধন এবং বাংলার হিন্দু জাতীয় চরিত্র নিয়ন্ত্রণে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান অপরিসীম। জীবীতকালেই তিনি সাহিত্যস্রষ্টারূপে খ্যাত হন। তিনি একজন সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। চাকুরি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। কর্মজীবনের অংশ হিসেবে পশ্চিম উত্তর ও মধ্য বাংলায় তাঁর জীবন অতিবাহিত, বিচিত্র মানুষকে তিনি দেখেছেন, মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ হয়েছিল। তাছাড়া উর্ধ্বতন ইংরেজ কর্মচারীদের আচার আচরণ এবং বিচার পদ্ধতিও সম্যক অবহিত হয়েছিলেন। বহিরাগত চাপ ও ভিতরকার ক্রটি দূর করে বিশেষতঃ হিন্দু বাঙালি চরিত্রকে সংহত করবার প্রয়াসে বঙ্কিমচন্দ্র জীবনব্যাপী লেখনী চালিয়ে গেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বপুরুষেরা হুগলীতে বসবাস করতেন। পূর্বপুরুষ রামহরি চট্টোপাধ্যায়ের কাল থেকেই চব্বিশ পরগণার কাঁঠালপাড়ায় তাদের বসতি