যেন অনেকদিন পরে বিস্মৃতির ওপার থেকে তুমি চলে এলে আমার কাছে। মনে পড়ে, সেই যে নদীটির ধারে কুয়াশার ভেতরে কাশবনে হারিয়ে গিয়েছিলাম। দু'জনে, যে নদীটির নাম ছিল পদ্মা, সে কতদিন আগে, যখন সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশে কান্নার ভেতর দিয়ে আনন্দের বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, কালাের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল আলাে ও আশা,যখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরবেন বলে চারদিকে অশ্রুভারাক্রান্ত আবেগ, যখন তােমার ছিল না কোনাে বাধন, কিন্তু আমি ছিলাম সম্পর্কের নাগপাশে বাধা, আমার ছিল পােড়া ও জ্বলে যাওয়া একটা সংসার আর সে সংসারের অঙ্গার মেখে আমার শরীর ছিল পরিশ্রান্ত, মন উদ্ভ্রান্ত, দৃষ্টি ঝাপসা, ঠিক সেই সময় যেন তুমি আমার কাছে এসে দু'হাত মেলে দাঁড়ালে। সে মমতার হাত অমি ফিরিয়ে দেই কী করে? আমার তাে ছিল না সেই শক্তি যা দিয়ে আমি প্রতিহত করি তােমাকে, ফিরিয়ে দেই তােমার প্রেম। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভঙ্গুর ও ক্ষতবিক্ষত একটি দেশের মতাে আমারও তাে সে সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন ছিল প্রেমের, দরকার ছিল শর্তহীন এক ভালােবাসার এবং নিঃস্বার্ণ এক আনুগত্যের। আনার বন্ধু, আমার মিতা, তােমাকে যে-কোনাে একটা নামে ডাকতে তাে আর বাধা নেই, যা মনে চায় তাই বলে ডাকলেও তাে তুমি আর সাড়া দেবে না, তুমি তাে এ সংসারের সব দেনা-পাওনা চুকিয়ে চলে গেছ তােমার সেই আকাক্ষিত জগতে যেখান বসে তুমি শুধু ছবি আঁকবে। আঁকবে কুয়াশার নদী, মানুষ ও দুঃখ, আঁকবে বড় বড় লাল গােলাপ যার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠবে সৌন্দর্য ও প্রেম, আঁকবে সেই কালাের ভেতরে “আছে' ও লালের ভেতরে ‘নেই'। | আর তাে তােমাকে সকাল-বিকাল রােগী দেখতে হবে না। হাসপাতালে ও চেম্বারে দিবারাত্রি পড়ে থাকতে হবে না। তােমার ছাত্রছাত্রীরা আর তােমার জন্য উৎসুক হয়ে করিডােরে দাঁড়িয়ে থাকবে না। দেশে-বিদেশে কনফারেন্সে আর তােমাকে পেপার পড়তে হবে না, আর কেউ তােমার মনােযােগ ঠিকমতাে পাচ্ছে না বলে অনুযােগ করবে না। তােমার ছেলেটি বিদেশী মেয়ে বিয়ে করেছিল বলে মনে বড় আঘাত পেয়েছিলে, হয়তাে এমনও হতে পারে তােমার মৃত্যু ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে এটিও একটি কারণ। মানুষের আশা ও আত্ম-অহমিকা যখন ভেঙে চৌচির হয়ে যায়, তখন কি আর জাগতিক কোনাে সুখ তার মনে সান্ত্বনা এনে দিতে পারে? মানুষের আত্মপরিচয় যখন বিনষ্ট হয়, তখন কে কবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে!