১২ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। সময় সন্ধ্যা। আমন্ত্রিত অতিথিদের সংখ্যা প্রায় শ'খানেক। বেঙ্গল ল্যান্সারের ভারপ্রাপ্ত কমান্ড্যান্ট মেজর ফারুক রহমান ও তার সুন্দরী স্ত্রী ফরিদার তৃতীয় বিয়েবার্ষিকী উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছে। ঢাকা গলফ ক্লাবে আয়ােজিত এ অনুষ্ঠানটির কথা সম্ভবত আমন্ত্রিত অতিথিদের কেউ ভুলবেন না। ফারুক ও ফরিদা ছিলেন সেনাবাহিনীর জনপ্রিয় দম্পতি। দেশের সম্রান্ত, শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি এরা। সরকারি কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে রয়েছে এদের নিবিড় যােগাযােগ। ফলে এই অনুষ্ঠানে অনেক বিশিষ্ট লােক উপস্থিত হবেন এটাই স্বাভাবিক।
অনুষ্ঠানে আর্মি হেড কোয়াটার্সের ব্যান্ডে আধুনিক বাংলা গানের সুর ভেসে আসছিলাে। ক্লাবের ভেতরে তখন রান্না হচ্ছে খাসির বিরিয়ানি, কাবাব, সুস্বাদু তরকারি এবং নানা রকমের সালাদ। চারপাশে ছিলাে প্রচুর সামরিক লােকজন। চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফও উপস্থিত ছিলেন এ অনুষ্ঠানে। সম্পর্কে তিনি মেজর ফারুকের মামা। উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক, ফারুকের অন্যান্য বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনরা। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিলাে ফারুক দম্পতির জন্য নানারকম উপহার সামগ্রী। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার হক গণভবনের প্রধান মালীকে দিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়ে এসেছেন চমৎকার একটি ফুলের তােড়া। তিনি নিজেই ফরিদার হাতে তুলে দেন এই সুদৃশ্য তােড়াটি। | তিনদিন পর, আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রায় সবাই সেই অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোন সূত্র আবিষ্কার করতে পারেননি এদের কেউই। আর, ব্রিগেডিয়ার হক গােপনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। সম্ভবত ফরিদাকে দেয়া পুস্পস্তবকই জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে তার।
কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের রাতে ফারুক তার গােপন পরিকল্পনার কথা কাউকেই বুঝতে দেননি। পরে তিনি জানিয়েছিলেন, ওই অনুষ্ঠানটির খরচ বহন করার জন্য তার প্রিয় অটোম্যাটিক স্লাইড প্রােজেক্টরটি মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছিলাে। তার জন্যে এটি ছিলাে ভয়ংকর পরিস্থিতি। যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, তার জন্য তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে যেতে হতে পারতাে। ফারুক পরে বলেছিলেন, এই অনুষ্ঠানটি আমি উপভােগ করতে চেয়েছিলাম। কারণ, এটা হতে পারতাে আমার জীবনে শেষ অনুষ্ঠান। | আমন্ত্রিত অতিথিরা বিদায় নেবার পর, ফারুকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। পরিজনদের ছােট্ট দলটি লনে বসে কফি খাচ্ছিলাে আর গল্পগুজব করছিলাে। এদের মধ্যে ছিলেন ফারুকের মা-বাবা, চট্টগ্রাম থেকে আসা ফরিদার মা, বড় বোেন জুবায়দা, যার ডাক নাম টিংকু। টিংকুর সঙ্গে ছিলেন তার স্বামী ঢাকাস্থ ২য় ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডেট মেজর খন্দকার আবদুর রশীদ। ফারুক তার ভায়রা মেজর রশীদকে এক পাশে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আমি এটা ১৫ তারিখেই করতে যাচ্ছি। শুক্রবার সকালেই আমি মুজিবকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেবাে।'
রশীদ হতভম্ব হয়ে গেলেন। ভয়ে ভয়ে তাকালেন এদিক-সেদিক, কেউ আবার এই ভয়ংকর কথাটি শুনে ফেললাে কি না। অবশেষে কয়েক মাসের গােপন পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌছেছে। কিন্তু রশীদ প্রস্তুত ছিলেন না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনিও ফিসফিস করে বললেন, “তুমি কি পাগল হয়েছ? এতাে অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে সম্ভব এটা? আমাদের সঙ্গে খুব বেশি অফিসার নেই। অস্ত্রও নেই। এ অবস্থায় এটা কি করে সম্ভব? কিন্তু ফারুক দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, এটা আমার ডিসিশান। প্ল্যান সব ঠিক হয়ে আছে। কেউ যদি আমার সঙ্গে না আসে, তাহলে আমি একাই এটা করবাে। তুমি ইচ্ছা করলে দূরে সরে থাকতে পারাে। কিন্তু মনে রেখাে, আমি ব্যর্থ হলে, ওরা তােমাকেও ফাঁসিতে ঝােলাবে।' অনেকক্ষণ চুপ থেকে রশীদ বললেন, ঠিক আছে। কাজটা যখন করতেই হবে, তখন একসঙ্গেই করবাে। কিন্তু আমাদের মধ্যে আরাে। আলােচনা হওয়া দরকার। আমি আরাে কিছু অফিসারকে সঙ্গে নিতে চাই। শহরের অন্য প্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রােডের বাড়িতে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। দুদিন পরে তার ভাগ্নির বিয়ে। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবত। সেরনিয়াবত তখন বন্যা। নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য, বন, বিদ্যুৎ ও পানি উন্নয়ন মন্ত্রী। সেখানে সোনিয়াবতের ছেলে আবুল হাসনাতও উপস্থিত ছিলেন। যিনি তিনদিন পর বঙ্গবন্ধুর । পরিবারে নেমে আসা ভয়ংকর বিপর্যয় থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিব তাঁর বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রীর সঙ্গে দেশের আসন্ন। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করছিলেন। আবুল হাসনাত পরে জানিয়েছেন, সেদিন তার মামা আসন্ন বন্যা-.. | পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি তার বাবাকে বলছিলেন খুব। শিগগিরই আমি ভারত থেকে কিছু ড্রেজার কিনছি।' বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, যখন আমি খুব ছোেট। তখন নদীর তীরে আমি ব্রিটিশদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। ওরা ছিলাে ড্রেজার কোম্পানির কর্মচারী। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে সমস্ত ড্রেজার বার্মায় নিয়ে যাওয়া হয়। এগুলাে আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। তখন আমরা যেখানে খেলতাম, সেখানে আর নদী নেই। সব ভরে ফেলা হয়েছে। ফলে প্রতি বছরই বন্যা লেগে আছে।' | বঙ্গবন্ধু আরাে বলছিলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে আমার অত টাকা নেই। কিন্তু আমি কিছু ড্রেজার পাচ্ছি। তােমরা দেখ, সমস্ত নদী আমি। পরিষ্কার করে ফেলবাে। আমার বাকশাল অন্তত এটুকু করতে পারবে। আবুল হাসনাত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন, মামার শেষ কথাটি আমার মনে খুব দাগ কেটেছিলাে। তিনি বলেছিলেন, কেউ বুঝলাে না, আমি আমার দেশের জন্যে কি করছি।' বঙ্গবন্ধু একটি কথা প্রায়ই বলতেন, “আমার শক্তি এটাই যে আমি আমার জনগণকে ভালবাসি। আর, আমার দুর্বলতা, আমি এদের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন না, আগস্টের কোনাে এক রাতেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে এক ভয়ংকর বিপর্যয়।
অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস এর বাংলাদেশ একটি রক্তাক্ত দলিল এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 200.00 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। Bangladesh Ekti Roktakto Dolil by Anthony Mascarenhasis now available in boiferry for only 200.00 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.