মো. সাহাবুদ্দিন চুপপু বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি। তিনি অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, উদার এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অতন্দ্র প্রহরী। কর্মজীবনে জেলা ও দায়রা জজ, দুদকের কমিশনার ও সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। তাঁর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর, জন্মস্থান পাবনা শহরের শিবরামপুরের জুবলী ট্যাংক মহল্লায়। পিতা শরফুদ্দিন আনছারী, মাতা খায়রুন্নেসা। তিনি ১৯৬৬ সালে পাবনা আর এম একাডেমী থেকে এসএসসি, ১৯৬৮ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২) একই কলেজ থেকে বিএসসি এবং ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর এলএলবি এবং বিসিএস (বিচার) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ আহ্বানে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি এবং বাকশালের পাবনা জেলা যুগ্ম—সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, সাতষট্টির ভুট্টা আন্দোলন, উন—সত্তরের গণ—আন্দোলন, সত্তরের নির্বান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাবনায় যাঁরা স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পাবনা জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে পাবনার ছাত্র—জনতার যে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়, তিনি ছিলেন তাঁর অন্যতম নেতৃত্বদানকারী। ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা পুনরায় পাবনা দখল করে নিলে ভারতে গমন করেন । তিনি মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রিলিফ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এরপর দেরাদুন মিলিটারি একাডেমি থেকে মুজিববাহিনীর সদস্য হিসেবে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর পাবনার সানিক দিয়র চরসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার—আলবদর ও নকশালদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে কাজ করেন। তাঁর সংসার—জীবন শুরু ১৯৭২ সালের নভেম্বও মাসে। তাঁর সহধর্মিণী ড. রেবেকা সুলতানা সরকারের যুগ্ম—সচিব ছিলেন। বর্তমানে প্র্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্চ প্রোগ্রাম বিভাগের অধ্যাপক এবং ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান। তাঁদের একমাত্র পুত্র আরশাদ আদনান রনি লন্ডন থেকে ম্যানেজমেন্টে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জ করে ব্যাংকে কর্মরত। সাহাবুদ্দিন চুপপু বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৭২ সালে পাবনা নগরবাড়ি ঘাট জনসভায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাহাবুদ্দিনের বক্তৃতা শুনে বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হন এবং হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যান। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বহুবার বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও স্নেহ লাভ করেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুহত্যার খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদী মিছিল বের করেন। এ বছর ২৮ আগস্ট তাঁকে গ্রেফতার করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। সামরিক স্বৈরশাসকদের রোষানলে দীর্ঘ তিন বছর কারনির্যাতন ভোগ করেন। এমনকি ওই সময় তাঁর স্ত্রী এবং শিশুপুত্রকেও গ্রেফতার করে হাজতে রাখা হয়। ১৯৭৮ সালে হেভিয়াস কার্পাস আপিলের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করেন। এরপর পাবনা জজকোর্টে আইন পেশায় যুক্ত হন এবং দৈনিক বাংলার বাণীর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিচারালয়ের বিভিন্ন পদে চাকুরি করে জেলা ও দায়রা জজ পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেস্ক অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক আইন সম্মেলনে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার মামলায় আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কতৃর্ক নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। এরপর সুপ্রীম কোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতা তদন্তে তাঁকে চেয়ারম্যান করে ২০০৯ সালে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এরপর দুদকের কমিশনার ও ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে তথাকথিত দুর্নীতি তদন্ত করে তিনিই সর্বপ্রথম সে অভিযোগ ভুয়া প্রমাণ করেন, পরবর্তীকালে কানাডার আদালতও একইরকম রায় দেয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং প্রচার ও প্রকাশনা উপ—কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। একজন কলামিস্ট হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। জাতীয দৈনিকগুলোতে তাঁরনিয়মিত কলাম প্রকাশিত হয়। ‘এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ তাঁর প্রথম বই।