ভূমিকা
নানা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ভাবনা জগতের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য ইংরেজী লেখাপত্রের দ্বারস্থ হই। পড়তে গিয়ে তেমনি অনেক ইংরেজী লেখাকেই অনুবাদ করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু অনুবাদ কর্ম আমার বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় নয়। তবু প্রলুব্ধ হয়ে কিছু লেখা অনুবাদ করে ফেলেছি। লক্ষ্য ছিল অনুবাদ করতে গিয়ে লেখাটিকে আরো খানিকটা নিঙড়ে পড়া, সেই সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষি বৃহত্তর পাঠকের সামনে লেখাটিকে উপস্থিত করা। শিল্প এবং সমাজ বিষয়ক নানা ভাবনা তেমনি সাতটি প্রবন্ধের অনুবাদ এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হল।
প্রবন্ধগুলোর খানিকটা পরিচয় দেয়া যাক। ইতিহাস বিষয়ক একটি প্রবন্ধ রয়েছে হাওয়ার্ড জিন-এর। হাওয়ার্ড জিন আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। আশির দশকের গোড়ায় রচিত তার ‘এ পিপলস হিস্টরি অব ইউনাইটেড স্টেটস’ বইটি আমেরিকায় তুমুল আলোড়ন তোলে। তিনি আমেরিকার ইতিহাসকে সেদেশের আধিবাসী, অভিবাসী, শ্রমিক এমনকি অন্ত্যজ মানুষের দৃষ্টি কোণ থেকে বর্ণনা করে সেদেশের ইতিহাস পাঠের প্রচলিত ধারাকে তীব্র আঘাত করেন। এখানে করম্বাস বিষয়ে হাওয়ার্ড জিনের যে লেখাটি রয়েছে সেটি তিনি তার বইয়ের সূত্র ধরেই লিখেছিলেন ১৯৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কারের ৫০০ বছর পূর্তি উৎসবের সময়। এ লেখায় তিনি আমেরিকার আদিবাসীদের চোখে কলম্বাসকে দেখতে গিয়ে কলম্বাসের বীরত্ব এবং মহত্ব সংক্রান্ত প্রচলিত ধারনা গুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
গ্রীসের সম্মানিত লেখক কাজান জাকিসের একটি স্মৃতি কথামূলক লেখা রয়েছে রাশিয়া বিষয়ে। ১৯২৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দশক বার্ষিকী পালন উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন কাজান জাকিস। একজন লেখকের সংবেদনশীলতায় তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সেই সময়কার রুশ জীবনকে। রুশ বিপ্লব এবং পরবর্তী কালে তার পতন বিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম ঘটনা। রুশ বিপ্লবের সেই প্রাথমিক স্তরেই কাজান জাকিস লক্ষ্য করেছিলেন সেখানকার মানুষের অর্ন্তজগতের টানাপোড়েনটিকে । তার পর্যক্ষেন পরবর্তী রুশ ইতিহাস অনুধাবনের একটি সূত্র হতে পারে। এ লেখাটি কাজান জাকিসের আন্তজৈবনিক রচনা ‘রিপোর্ট টু গ্রেকো’ থেকে নেয়া হয়েছে।
মনস্তত্ত্ব বিষয়ে লেখা রয়েছে কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এর । ফ্রয়েডের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী মনোবিজ্ঞানী হলেন সুইজারল্যান্ডের কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং। বিশেষ করে তার যৌথ অবচেতনা ধারনাটি মনোবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মেচিত হয়। এই যৌথ অবচেতানা বিষয়ে তারা ১৯৩৬ এ দেয়া একটি বক্তৃতার অনুবাদ রয়েছে এখানে। বক্তৃতাটি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে জোসেফ ক্যাম্পবেলের ‘দ্য পোর্টবল ইয়ুং’ বইয়ে। এই অনুবাদটি চট্রগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘লিটল ম্যাগাজিন ’ নামক সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে ।
সাহিত্য বিষয়ে লেখা রয়েছে নাইজেরিয়ার বিখ্যাত লেখক চিনুয়া আচেবের । এটিও একটি বক্তৃতা যা তিনি দিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ,১৯৮৫ সালে । এ লেখায় তিনি আফ্রিকা এবং ইউরোপের প্রেক্ষাপটে লেখক, সমাজ সম্পর্কে বিষয়টি আলোচনা করেছেন । তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কি করে ইউরোপের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ এবং আফ্রিকার যৌথজীবন চেতনা দুই মহাদেশে লেখকের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। এই বক্তৃতাটি চিনুয়া আচেবের ‘হোপস এন্ড ইমপেডিমেন্ট ’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ।
চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে লেখা রয়েছে ব্রিটশ চলচ্চিত্রতান্ত্রিক আর্নষ্ট লিন্ডগ্রেনের । চলচ্চিত্রে সৃজনশীলতা অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সৃজনশীলতার সঙ্গে তুল্য কি না এ নিয়ে তাত্ত্বিক মহলে একসময় বিতর্ক ছিল। সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্র কলা সহ অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে চলচ্চিত্রে দৃষ্টি প্রক্রিয়ার তুলনামূলক আলোচনা করে লিন্ডগ্রেন চলচ্চিত্রের শিল্পরুপটি ব্যাখ্যা করেছেন। এই লেখাটি লিন্ডগ্রেনের ‘দ্য আর্ট অব ফিল্ম’ গ্রন্থে অন্তভুক্ত আছে। এই অনুবাদটি চল”্চত্রি বিয়ষক পত্রিকা ‘লক থ্রু’ তে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে।
বিশিষ্ট অস্ট্রিয় নন্দনতাত্ত্বিক এবং সমালোচক আর্নষ্ট ফিশারের দুইটি লেখার অনুবাদ রয়েছে এই বইয়ে। আর্নষ্ট ফিশার মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পসমালোচনা করে থাকেন। মার্ক্সবাদী শিল্প আলোচনাকে রক্ষণশীলতামুক্ত করার ক্ষেত্রে তার অবদান রয়েছে। তাঁকে এক সময় মার্ক্সবাদের এ্যারিস্টটল হিসেবে আখ্যায়িত করা হত। এখানে তার একটি লেখা রয়েছে সঙ্গীত বিষয়ে। সঙ্গীতকে সাধারণ ভাবে সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উর্ধ্বে একটি বিশুদ্ধ শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু নানাবিধ সামাজিক অনুষঙ্গ যে সুর সৃষ্টিকেও প্রভাহিত করে ফিশার সে আলোচনাই রয়েছেন। তার আলোচনা মূলত পাশ্চাত্য সঙ্গীত ভিত্তিক হলেও তা অন্যান্য দেশের প্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক । এই অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল র্শিল্প সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ‘প্রসঙ্গ’তে ১৯৮৮ সালে।
ফিশারের অপর লেখাটিতে পুঁজিবাদী সমাজ বিকাশের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির যে পরিবর্তন ঘটেছে সে বিষয়টি আলোচনা হয়েছে । এই প্রবন্ধটি এ বইয়ের দীর্ঘতম রচনা। কয়েক শতাব্দীব্যাপি শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন আন্দোলন গুলোকে তিনি সমাজ বিকাশের পেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছেন। আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বিশ্ব পেক্ষাপটে সমাজতান্ত্রিক শিল্প বিষয়ে তার ধারনা গুলোকে এক পেশে মনে হতে পাওে কিন্তু তার সামগ্রিক বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি আমাদের মনোযোগ দাবী করে। এই অনুবাদটি ‘শিল্প সাহিত্য ও পুঁজিবাদ’ শিরোনামে ১৯৮৮ সালে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেছিল চট্রগ্রামের ‘চর্যা’ প্রকাশনী।
উল্লেখ্য, কলম্বাস বিষয়ে হাওয়ার্ড জিনের লেখাটি সংগ্রহ করে দিয়েছেন ডাঃ সৈয়দ মাসুদ আহমেদ এবং কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এর অনুবাদটি, যা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম, সংগ্রহ করে দিয়েছেন শৈবাল চৌধুরী। তাদের ধন্যবাদ জানাই। পরিশেষে এই অনুবাদ গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের এই নীতি মালা অনুযায়ী জানুয়ারী ০১,২০১১ হতে কার্যকর । উক্ত নীতি মালার যে কোন ধরনের সংশোধন ,সংযোজন , পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের ক্ষমতা একমাত্র “অন্য রকম ডট” পরিচালনা পরিষদ সংরক্ষণ করেন।
শাহাদুজ্জামান
সূচিপত্র
* কলম্বাস : অন্য চোখে
* রাশিয়া : ১৯২৭
* যৌথ অবচেতনা
* লেখক, সমাজ সম্পর্ক
* চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ
* সঙ্গীতে সমাজচেতনা
* শিল্প সাহিত্য এবং পুঁজিবাদ