মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে একটা বয়ান হাজির আছে। সেই বয়ানে ইসলাম অনুপস্থিত। আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করানো হয়েছে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক ছিল। এভাবেই তৈরি হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য আর হেরিটেজের নির্মান। ঐতিহ্য বা হেরিটেজ আসলে ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত এক একটি ডিসকোর্স বা বয়ান। অর্থাৎ ইতিহাসের হাত ধরে গড়ে ওঠে এমন একটা চলতি বয়ানই হচ্ছে ঐতিহ্য বা হেরিটেজ। এই ঐতিহ্যকে আমরা কোন সচেতনতা ছাড়াই বহন করি, তার উৎস বা কার্যকারন না জেনেই। রোলা বার্তে তার মিথোলজিস বইয়ে বলেছেন, আমরা যেই বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করি তার জমিনটা তৈরি করে দেয় ইতিহাসের কোন বয়ানের মধ্যে আমরা বাস করি তা। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লড়াই হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের জন্য। পাকিস্তানি শাসকেরা ইসলামের নাম নিয়ে তাঁদের গণহত্যা জায়েজ করতে চেয়েছে। আবার সেইসময়ের কয়েকটা ইসলামপন্থী দল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অবস্থান নেয়ার জন্য এইদেশের বাম ও স্যেকুলারপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের প্রশ্নে বুর্জোয়া ফয়সালা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। কিন্তু আসলে মুক্তিযুদ্ধের নির্মানে, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনায় ইসলাম ছিলো প্রাধান্য বিস্তারকারী বয়ান। মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীন বাঙলা বেতার 'আল্লাহর পথে জেহাদ' বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মাঠের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ছিল ইসলাম, তারা শক্তি নিয়েছে ইসলামের ন্যারেটিভ থেকে। স্বাধীন বাঙলা সরকারের বক্তব্য বিবৃতিতে ইসলাম ডমিন্যান্টভাবে বর্তমান ছিলো।
ইতিহাসের ধুলোকালি
বাংলাদেশে প্রচলিত রাজনৈতিক বয়ানে অনেক ঐতিহাসিক বিষয়কেই ভুলভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। ইতিহাসের এই ভুল উপস্থাপনের একটা হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। ভুল ইতহিাস চর্চা আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা আর আত্মপরিচয়ের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে রেখেছে। ইতহিাসের ওপরে এই আরোপিত ভুল চর্চার ফলাফল হয়েছে মারাত্মক। ইতিহাসের ভুল আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত বয়ানের ফলেই বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতি চর্চার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই ভুল ইতিহাস চর্চাকে অবাধে চলতে দিলে ইতিহাসের এই উদ্দেশ্যমূলক বয়ানই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সত্য বলে ধরে নেবে। ইতিহাসের ওপরে জমে থাকা ধুলোকালিকে যতটুকু পরিচ্ছন্ন করা যায়, ততই আমাদের জাতির মঙ্গল। ‘ইতিহাসের ধুলোকালি’ গ্রন্থ আমাদের ইতিহাসের গায়ে লেপ্টে থাকা ধুলোকালি ঝেড়ে পরিষ্কার করার একটা প্রয়াস।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এর শেখ মুজিবের শাসনামল স্বাধীন বাংলাদেশের গতিমুখ ঠিক করেছে। এইসময়ের সদ্য স্বাধীন দেশ যেভাবে রাষ্ট্রগঠনের পথে অগ্রসর হয়েছিলাে সেটাই আজকের। | বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। মুজিব আমলের যেই বয়ান । বাংলাদেশের আওয়ামী বলয়ের বুদ্ধিজীবিদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে সেটাই হয়ে দাড়িয়েছে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের। চলতি বয়ান। সেই বয়ানের উপরে দাড়িয়ে আছে মুজিব শাসনের এক স্বপ্নল ভাবমুতি এবং ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে আমরা কোন সচেতনতা ছাড়াই বহন করি, তার উৎস বা কার্যকারন না জেনেই। রােলা বাতে তার মিথােলজিস বইয়ে বলেছেন, আমরা যেই বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করি তার জমিনটা তৈরি করে দেয়। ইতিহাসের কোন বয়ানের মধ্যে আমরা বাস করি তা। ফলে মুজিব আমলের দুঃশাসন, রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতা, নজিরবিহীন দবত্তায়ন ও ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। ইতিহাসের কোন একাডেমিক অন্বেষণকে অসম্ভব করে তােলা হয়েছে। লেখক ইতিহাসের ধুলাে কালি সরিয়ে সেই চেপে রাখা ইতিহাস নির্মোহভাবে আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছেন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম খণ্ডে।
মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৭১
এই বইয়ে। আমেরিকা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচলিত বয়ানের বিপরীতে যা যা পাবেন :
“বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাধা দেয়ায় জন্যে। আমেরিকা পাঠায়নি”
“স্বাধীন বাংলা সরকার শপথ নেয়ার আগেই সি আই এ মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষুদ্র। অস্ত্র দেয়ার ব্যাপারে আলােচনা করেছিল।
“পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্যে আমেরিকা। পাকিস্তানকে চাপ দিয়েছিল”
“পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১০ ডিসেম্বরেই ঢাকায় জাতিসংঘের কাছে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক ইচ্ছে জানায়"
“সােভিয়েতরা আমেরিকান স্বার্থ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে একসঙ্গে কাজ করেছিল”
এনলাইটেনমেন্ট থেকে পোস্ট মডার্নিজম: চিন্তার অভিযাত্রা
আধুনিকতা বা মডার্নিজমের মতাে উত্তর-আধুনিকতাও একটি দৃষ্টিভঙ্গি। আধুনিকতার ধারণার অভিঘাতেই তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে জন্ম নিয়েছে উত্তর-আধুনিকতা বা পােস্ট মডার্নিজম। উত্তর-আধুনিকতাকে বােঝার জন্য আমাদেরকে প্রথমেই আধুনিকতাকে বুঝতে হবে। কেননা, এর মধ্য থেকেই উত্তর-আধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। আধুনিকতার জন্ম আবার পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিজমের মনােগাঠনিক চিন্তা হিসেবে। এই আধুনিকতাকে বােঝা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর জটিল চিন্তা-কাঠামাে বােঝা রীতিমতাে অসম্ভব। পােস্ট মডার্নিস্ট চিন্তা ঠিক কীভাবে আধুনিকতার ক্রিটিক করে সেটা জানাও জরুরি। এনলাইটেনমেন্ট থেকে পােস্ট মডার্নিজম; চিন্তার অভিযাত্রা বইতে খুব সহজ করে আধুনিকতা আর উত্তর-আধুনিকতাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।