১৯৯৫ সালের পঞ্চম রমজানের রাতটা ভায়ারহাট গ্রামের বাসিন্দাদের মনে বহুদিনের জন্য স্থান করে নিল। তিস্তা নদীর পশ্চিম পাড়ে, রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার এক অতি সাধারণ গ্রাম ভায়ারহাট। এ গ্রামের বাজারের মসজিদের মােয়াজ্জিন আব্দুল মােতালেব মিয়া আগেভাগেই সেহরি খেয়ে ওযু করে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে ভাবলেন, এমন অন্ধকার কি আগে কখনাে পড়েছে? রাতের অন্ধকারের কি কম-বেশি আছে? শীত-গরমের যদি কম-বেশি থাকতে পারে, অন্ধকারের কম-বেশি হতে দোষ কী? আজকের মতাে গরম আর কখনাে পড়েনি’র মতাে এমন অন্ধকার আর বাপের জন্মে। দেখিনি' কি বলা যায়? ধ্যাত! কী ভাবছেন এসব! এগুলােই কি বয়সের লক্ষণ? শীত কি এজন্যেই বেশি লাগছে? মােতালেব মিয়া চাদরটা ভালােভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। হ্যারিকেনের আলােটা বাড়িয়ে দিলেন। কেরােসিনের খরচ বাঁচানাের জন্য সলতেটা ছােট্ট করা ছিল। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে অল্প আলােতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে সলতেটা বড় করতে হলাে। কুপি নিয়ে রাত-বিরেতে যাওয়া-আসা করতে মােতালেবের কষ্ট হয় বলে এই হ্যারিকেনটা তাকে গত বছর কিনে দিয়েছিলেন গণু মােল্লা। মােল্লার দেওয়া এই হ্যারিকেনটা ব্যবহার করার কোনাে ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু সেটা ব্যবহার না করলে গণু মােল্লা মন খারাপ করবে, তাই বাধ্য হয়ে ব্যবহার করেন। গণুর মন খারাপ করে দেওয়ার মতাে সাহস নাই মােতালেবের। ২৪ বছর আগেই সেই সাহস হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। সেই বিভীষিকাময় সময়ে কেউ বাড়ি-ভিটে হারিয়েছে, কেউ বাবা-মা হারিয়েছে, কেউ হারিয়েছে ভাই-বােন। মােতালেব হলেন সবচেয়ে বড় অভাগা, তিনি হারিয়েছেন নিজেকে, নিজের সাহস এবং সত্ত্বাকে। | মােতালেব হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দিলেন। ফজরের আযানের দেরি আছে। তিনি আগেভাগে যেতে চাচ্ছেন অন্য কারণে। তিনি মসজিদের মাইকে সেহরি খাওয়ার শেষ সময়ের ঘােষণা দেন, রােজা রাখার নিয়ত পাঠ করেন। মাঝেমধ্যে গজলও পাঠ করেন। আজও একটা গজল পরিবেশনের ইচ্ছে আছে তার।