সৃষ্টির উন্মত্ততায় অন্তর্নিহিত জীবনের যে ব্যাপ্তি, তা একজন গল্পকারকে ছোটগল্প লেখায় অনুপ্রাণিত করে। জীবনের এই বিস্তৃত উপাখ্যানের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ঘটনা-দুর্ঘটনা ও বিচিত্র অনুভূতিগুলোর সমন্বিত পদবিন্যাসই ছোটগল্পের মূল ভিত্তি। সময়ের বিরুদ্ধস্রোতে বহমান জীবনের যে অনন্ত পরিভ্রমণ, বেঁচে থাকার আকুতি এ সমস্তই ছোটগল্পের কাঠামো নির্মাণ করে দেয়। কথাসাহিত্যিক এস এম জাকির হোসেনের গল্পগুলো- এই একই তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্টকে ধারণ করেই রচিত হয়েছে।
মা জোনাকির নীল কষ্ট বুকে নিয়ে অন্ধকার রাজ্যে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নাজমার অন্তরের আলোটুকু ঠিকই অনুভব করতে পারে মতিন, অন্যদিকে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়ানো যুবক অনিরুদ্ধ কখনও নীলার চোখে চোখ রেখে বলতে পারে না- ভালোবাসি, ভালোবাসি। আবার অমিয়র বুকে মাথা রেখে রূপা ঠিকই খুঁজে পায় নির্ভরতা। একমাত্র সহোদর তপুর জন্য অপুর মনে কেন এত হাহাকার? ছোট্ট মেয়েটির কপালের ঠিক মাবাখানে লাল তিলকটি কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে, মেয়েটি কী করে সব শান্তি কেড়ে নিলো রবিনের? লুবনার দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস আর দৃপ্ত চেতনার আলোর দ্যুতি যেমন জাহানারার অনেকদিনের তৃষ্ণার্ত বুকে স্নেহ-মমতা বান ডেকে যায়, তেমনি বশিরের চোখের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ ছালেহার মনে হয়- 'আমার হাতের কাছে এমন রত্ন থাকতে আমি কেনো সাগর সেচে মুক্তো খুঁজতে গেলাম'। লম্বা বেণী দোলানো সেই শ্যামবর্ণা উচ্ছল মেয়েটির মুখচ্ছবি আর টানা টানা গভীর কালো দু'টি চোখ গভীরভাবে দাগ কেটে যায় মৃদুলের মনে। বাল্যবন্ধু আসাদকে দেখে কেন দু'চোখ ভিজে উঠল সজলের? শেকড় ছেঁড়ার কষ্ট ক'জন অনুভব করতে পারে, দীপুর মতো। সারাদিন বুকের মাঝে শূন্যতা পুষে রেখেও একমাত্র বাবাকে কাছে পেয়ে ছোট্ট রুমির বাঁধভাঙা চোখের জল। ঠিকই খুঁজে পেয়েছিল ভালোবাসার আশ্রয়।
এই গ্রন্থে লেখক এস এম জাকির হোসেন তার জাদুকরী দক্ষতায় শব্দজাল বুনেছেন; সমাজের তথা আমাদের চারপাশের বিচিত্র মানুষের জীবনাচরণ, প্রেম-বিরহ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন, কিংবা কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের মনে যে অসহায়ত্বের উদ্ভব ঘটে, সেই বোধ থেকে লেখক জীবনের গভীর সত্যকে বর্ণিল আখ্যানের মাধ্যমে নানাভাবে গল্পে তুলে ধরেছেন।
গল্পগুলোর বিষয় নির্বাচন এবং নির্মাণ শৈলীতে এখানেই তিনি স্বতন্ত্র। আমি উদীয়মান এই লেখকের মঙ্গল কামনা করি।