'মা যে জননী কান্দে' বইখানায় এবং ইতিপূর্বে প্রকাশিত আমার ‘সখিনা' কাব্যে মাঝে মাঝে আমি গ্রাম্য গীত-কবিতার ছন্দ ব্যবহার করিয়াছি। এই ছন্দকে কেহ যেন প্রচলিত বাংলা পয়ার ছন্দ মনে করিবেন না। বাংলা পয়ার ছন্দে তেমন ধূনিবৈচিত্র্য নাই; কিন্তু গীতি-কবিতার ছন্দ যদিও পয়ারেরই দোসর, লােক-সাহিত্যের কবিরা ইচ্ছামতাে শব্দ যােগ করিয়া ইহাতে নানা রকমের ধূনির সৃষ্টি করিয়াছেন । পাঠক লক্ষ্য করিবেন, ইহাতে মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও ত্রিপদী ছন্দ ইচ্ছামতাে ব্যবহৃত হইয়া নানা ধূনি-বৈচিত্র্য আনয়ন করা হইয়াছে। এই কবিতা সুর করিয়া গাওয়া হয় বলিয়া ইহার ছন্দ-রূপ লইয়া কেহ মাথা ঘামান নাই। কিন্তু গ্রামদেশে এই কবিতাগুলি পড়িবার বা আবৃত্তি করিবারও একটি সুর ও রীতি আছে। পাঠক দুই একবার চেষ্টা করিলেই তাহা আয়ত্ত করিতে পারিবেন ।
ইংরেজ আগমনের পূর্বে আমাদের দেশে প্রায় সকল রকম কাহিনীই কবিতাকারে রচিত হইত। তারপর গদ্যে কাহিনী লেখার রীতি প্রবর্তিত হইয়াছে। বর্তমান যুগের এক্স-রে দৃষ্টির মতাে গদ্যের লেখন মানবমনের যে সব অন্ধিসন্ধি খুঁজিয়া বাহির করেন কবিতা লেখকের সেই সূক্ষদৃষ্টি নাই। কিন্তু কবিতাকারে মানবমনের যে পেলবতা (delicacy) ও গভীর অনুভূতি প্রকাশ সম্ভব গদ্যে তা সম্ভব নয়। চোখের ডাক্তার নানা রঙের আলাে মেলিয়া ধরিয়া চোখের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ রন্ধ্রের সন্ধান পান, কবিতা লেখকের হাতে একটি মাত্র আলাে – তাঁহার কবিদৃষ্টি। হয়ত গদ্য লেখকের মতাে সূক্ষাতিসূক্ষ অণুবীক্ষণিক দৃষ্টি তাঁহার নাই কিন্তু কবিদৃষ্টি লইয়া তিনি যাহা দেখেন গদ্য লেখকের দৃষ্টিতে তাহা ধরা পড়ে না । হয়ত এই জন্যই ইবসেন এবং অতি আধুনিক কবিদের মধ্যমণি ইলিয়ট সাহেব তাঁহাদের কোন কোন নাটকের সংলাপগুলি কবিতাকারে রচনা করিয়াছেন । আমার লিখিত নক্সী-কাঁথার মাঠ’ ও ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট' পুস্তকের লােকপ্রিয়তা দেখিয়া মনে হয় আমাদের দেশে এখনও কবিতাকারে কাহিনীকাব্য উপভােগ করিবার বহু পাঠক-পাঠিকা রহিয়াছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানে মােশায়েরা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়া সেখানকার লােকেরা শিশুকাল হইতেই কবিতার প্রতি অনুরাগী হয়, কিন্তু আমাদের পূর্ব-পাকিস্তানে তেমন কোন অনুষ্ঠান গড়িয়া ওঠে নাই । আজকাল দুর্বোধ্য কবিতা লেখার রীতি একদল তরুণ লেখকদের পাইয়া বসিয়াছে। সেইজন্য এবং আরও বহু কারণে কবিতার পাঠক সংখ্যা দিন দিন কমিয়া যাইতেছে । বহু কারণের মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম ।
দেশের নানা অভাব অভিযােগের জন্য পাঠকসমাজ কতকটা বস্তুতান্ত্রিক হইয়া পড়িতেছেন। বর্তমান যন্ত্রসভ্যতার প্রভাবে মানুষের মন অনেকখানি যান্ত্রিক ও বস্তুতান্ত্রিক হইয়াছে। কবিতার মাধ্যমে সুন্দরের স্বপ্ন দেখার অবসর তাহার খুবই কম। জাতির কল্যাণ যাঁহারা চিন্তা করেন তাঁহারা দেশকে এই অবস্থার মধ্যে ফেলিয়া রাখিতে পারেন না। দেশের সব মানুষের হৃদয় যদি যন্ত্রদানবের প্রভাবে যন্ত্র হইয়া ওঠে, তাহা দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় না। মানুষ তাহা হইলে হৃদয়হীন হইয়া পড়িবে । কবিতার ছন্দ ও সুরের মাধ্যমে মানবমনের যে স্থানটি স্পর্শ করা যায় গদ্যে তাহা সম্ভবপর হয় না ! গদ্যেরও ধূনি আছে; কিন্তু তাহা কানের ভিতর দিয়া মরমে প্রবেশ করিতে পারে না। শুধুমাত্র ছন্দের কবিই বলিতে পারেন, আমার সুরগুলি পায় চরণ তােমার, পাই না তােমারে।
কবিতাকে লােকপ্রিয় করিবার জন্য তাই গল্পাকারে কবিতা লেখার প্রয়াস। সমালােচকদের মতে ইহাতে হয়ত কবিতাকে কল্পনার ইন্দ্রলােক হইতে মাটিতে নামাইয়া আনিতে হইয়াছে; কিন্তু মাটির উপরেই তাে আমরা বাস করি । মাটিকে অবহেলা করা যায় না। এই পুস্তকের অনেকগুলি অধ্যায় গাথা-কবিতার ছন্দে রচনা করিয়া ইহাকে দেশের আরও একদল পাঠকের নিকটতম করিতে প্রয়াস পাইয়াছি। পরিশেষে একটি কথা বলিয়া আমার মুখবন্ধ শেষ করিব । ইহা কাহিনীকাব্য । ইহার প্রত্যেকটি লাইনে কেহ যেন কবিতু আশা না করেন। এই কাব্যে বর্ণিত চরিত্রগুলি যদি জীবন্ত হইয়া পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণ করে, তবেই বুঝিব আমার লেখা সার্থক হইয়াছে।
এই পুস্তক প্রকাশে স্নেহভাজন তরুণ কবি আবদুর রফিক সন্যামত, গােলাম মুস্তাফা ও শামসুদ্দোহা আমাকে নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন। এই উপলক্ষে আরও একজনের কথা মনে পড়িতেছে। ইতিপূর্বে আমার সুচয়নী' কাব্যের পান্ডুলিপি তৈয়ার করিতে এবং অন্যান্য সাহিত্য প্রচেষ্টায় মােহাম্মদ বজলুল হক সাহেব নিঃস্বার্থভাবে দিনের পর দিন আমার সঙ্গে পরিশ্রম করিয়াছেন। এই সঙ্কলন সম্পাদন করিতে ' কবি জসীম উদ্দীন (কবি ও কাব্য)' গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম সাহেবও আমাকে কম সাহায্য করেন নাই। ইহাদের সকলের কাছেই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই ।
জসীম উদদীন এর মা যে জননী কান্দে এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 127.50 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। Ma Je Jononi Kande by Josim Uddinis now available in boiferry for only 127.50 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.