সার্থক শিল্পের একটি সর্বদেশীয় ভাষা থাকে। ভাবুক মাত্রই সেই ভাষাটি বােঝেন, তার শিল্প-সৌন্দর্য উপভােগ করেন। দৃষ্টিকোণ ও দৃষ্টিভঙ্গির বুনন-বিন্যাসের মধ্যেই নিহিত থাকে সর্বদেশীয় বােধগম্যতার চিরায়ত রহস্য। কিন্তু তবুও প্রতিটি শিল্পেরই একটি জন্মভূমি থাকে। একটি নির্দিষ্ট দেশের সংস্কার-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভূমিরূপ ও পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জল-হাওয়া ও রােদ-বৃষ্টির মধ্যে গড়ে ওঠে। শিল্পের দেহসৌষ্ঠব ও আত্মার আদিরূপ। মানুষের মনােগড়ন, মনোগড়নের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সমবেত সংস্কৃতির আলিক, অর্থনৈতিক বনিয়াদ এবং সেই বনিয়াদের মধ্যে গড়ে ওঠা জীবন, জীবনযাপন সংক্রিয় এক প্রক্রিয়ার মধ্যে শিল্পে মূর্ত হয়ে ওঠে। জাতিগত ঐতিহ্যের সেই বিপুলায়তন অবয়ব একটি শিল্পের আয়নায় প্রতিফলিত না-হয়ে পারে না। বিশেষ করে কথাসাহিত্যে এই চিত্রটির প্রতিবিম্ব প্রাণময় হয়ে উঠার কথা। কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুটার দিকে তাকালে শিল্পের এই ন্যায়সূত্রের হিসাব মিলে না। চর্যাপদের কবিতাগুলাের মধ্যে বাঙালি জীবনের আদি রূপের পরিচয় পাওয়া যায় । আভিজাত্য নয়, অর্থকীর্তি নয়, শান-শওকতও নয়—অতৰ সাধারণ এক জীবন এবং সেই জীবনের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের আলেখ্য রচিত হয়েছে এই আদি কাব্যগ্রন্থে। কবিতার রূপাবয়বের মধ্যে অসংখ্য গল্পের যে সম্ভাবনা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল চর্যাপদগুলােতে সেই অঙ্কুরিত গল্পের সম্ভাবনায় নিহিত আছে আমাদের কথাসাহিত্যের আদিকল্প। শুধু চর্যাপদে নয়, চর্যাপদের আগে-পরে প্রকাশিত সুপ্রচুর সাহিত্যকর্মে উপন্যাসােপম জীবনের অম্বল মিলে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে এর বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সংস্কৃত গদ্যসাহিত্য, বিশেষ করে কথাসরিৎসাগর, বেতাল-পঞ্চবিংশতি, দশমারচরিত, কাদম্বরী, ইত্যাদি গ্রন্থের বিশেষত্ববর্জিত ও প্রখীবন্ধ বর্ণনা-বাহুল্যের মধ্যে জীবন-তুষ্ণার পরিচয় পাওয়া যায়। আর এখানেই উপন্যাসের ইতিহাসপূর্ব ইতিহাস। পঞ্চতন্ত্র ও বৌদ্ধ জাতকগুলাের মধ্যে মানবিক জগতের বিস্তৃত পরিচয় লক্ষ করা যায়। জীবনের বহু বিপরীতের ঐকতানে এই জগৎ সমৃদ্ধ। বাংলা কথাসাহিত্য নিশ্চয়ই এই জগতের কাছে ঋণ স্বীকার করতে পারে।