জলমিছরি রিভিউ
"মনটা আমার ভীষণ খারাপ, চার দেয়ালে বন্দী..."
প্রায়শই যান্ত্রিকতার শহরে দম বন্ধ হয়ে আসে, শহুরে জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে মন ছুটে যেতে চায় গ্রামীণ আবহে। কিন্তু কর্মময় জীবনের ছুটির ঘণ্টা নিতান্তই কম। ফলশ্রুতিতে প্রাত্যহিক শহুরে জীবনের কংক্রিটের দেয়ালে বন্দী হয়ে ভীষণ খারাপ হয় মনটা। ইচ্ছে করে ফিরে যাই শৈশবে, মাতিয়ে রাখি নিজেকে গ্রামের স্নিগ্ধ আবহে, শ্বাস নিই মুক্ত বাতাসে যেখানে থাকবে না কোনো যান্ত্রিকতার ছোঁয়া। যদি তার বিকল্প পাওয়া যায়! বাস্তবতার মঞ্চে না হোক কল্পনার জগতে যদি হারিয়ে যাওয়া যায় গ্রাম্য পরিবেশে, উপলব্ধি করা যায় গ্রামীণ জীবনের রেশ তবে কি তাকে বিকল্প বলা যায় না? হ্যাঁ, আমার কাছে সেটাই বিকল্প হিসেবে নিয়েছে। রবিউল করিম মৃদুল রচিত "জলমিছরি" উপন্যাসটিকে আমি গ্রামীণ জীবনের বিকল্প বলছি। কিন্তু সামাজিক ঘরনার এই বইটির এহেন নামকরণের রহস্য কী?
হরিণচরা ও কুসুমহাটি গ্রামের কিছু মানুষের জীবন-জীবিকা, দ্বন্দ-কলহ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, ভালোবাসা-বিচ্ছেদ ইত্যাদিকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে "জলমিছরি"। দুটো গ্রামের এসাক-দিলজান, ও হাফিজুল-ফিরোজার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনচিত্রকে সমান্তরালে রেখে লেখক অত্যন্ত নিপুণ কৌশলে এগিয়ে নিয়েছেন উপন্যাসটি। গল্পের প্রয়োজনে আনয়ন করেছেন একাধিক চরিত্র যারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে পাঠকের হৃদয় নাড়িয়েছে। কোনো চরিত্রে প্রাধান্য দিয়ে অন্য চরিত্রকে ম্লান করেননি লেখক। শব্দ চয়নে লেখক অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ভাষার ব্যবহারেও সম্পূর্ণ উপন্যাসে ছিল লেখকের যথেষ্ট সচেতনতা। বিশেষ করে আঞ্চলিক তথা চরিত্রদের কথ্যভাষায়। কোথাও বিচ্যুতিও ঘটেনি।
"জলমিছরি" উপন্যাসের প্রারম্ভে দেখা যায় লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে হরিণচরা গ্রামের এসাক ডাকাতের স্ত্রী দিলজান বাছুর সদৃশ ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছে। সময়ের স্রোতে খবরটি ভেসে যায় গ্রামের সকলের কানে। দলে দলে মহিলারা এসাকের বাড়ি ভীড় জমায় অদ্ভুত ছেলে দেখতে। তাদের ধারণা দিলজানের পাপের ফসল এমন সন্তান। আসলেই কি সে বাছুর সদৃশ সন্তানের জন্ম দিয়েছিল? কখনও যাকে সন্তানসম্ভাবা মনে হয়নি সে কী করে সন্তান জন্ম দিলো? তা নিয়ে গ্রামময় চলে কানাঘুষা। গ্রামের মাতব্বর সম্প্রদায় এই সুযোগে তাকে গ্রামছাড়া করার পায়তারা শুরু করে। তারা কি সফল হবে? এসাক কি ছাড়বে নিজ ভিটে?
কুসুমহাটি গ্রামে হাফিজুলের বউ হয়ে আসে ফিরোজা। একবুক স্বপ্ন ছিল তার ভালো ঘর, ভালো বর, ভালো সংসার হবে তার। কিন্তু ভালো বর, সংসার পেলেও ভালো ঘর পায়নি সে। নিত্যকার অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ইঙ্গিত পেয়েছিল সে বিয়ের প্রথম দিনেই। প্রাচুর্যের অভাব থাকলেও তার সংসারে ভালোবাসার অভাব ছিল না কখনও। বর, শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়া তাকে ভালোবাসার জন্য ছিল আসাদ ও পরী; সম্পর্কে তারা হাফিজুলের মামাতো ভাই-বোন। বেশ ভালোই তো চলছিল সব। কিন্তু হঠাৎ যেন কী হলো! একদিন উধাও হয়ে গেল ফিরোজা। তবে চিরতরে নয়; তাকে খুঁজে পাওয়ার পর থেকে ঘটতে থাকে অলৌকিক কিছু ঘটনা। কিন্তু কেন এমন হয়? জানতে উদগ্রীব সকলে।
উপন্যাসে কালের পরিক্রমায় এসাকের জীবনে আসে এক কালবৈশাখী ঝড়। উড়িয়ে নেয় তার সুখের ঘর। বাসা বাঁধে সে অন্যত্র। সেখানে হানা দেয় ওলাবিবি। নিঃস্বার্থভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে সকলের তরে। কিন্তু তার কী হবে ভবিষ্যৎ? সে কি পারবে সকল ঝড় উপেক্ষা করে জীবনের স্রোতে ফিরতে? ফিরোজা-হাফিজুলের সবকিছু কি আগের মতো ঠিক হবে? কখনও কি তারা আর্থিক সুখের মুখ দেখবে? উপন্যাসের প্রারম্ভ থেকে একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে তার উত্তর খুঁজতে পড়তে হবে "জলমিছরি"
উপন্যাস হতে হয় জীবনের প্রতিচ্ছবি, যা পড়লে পাঠকদের হৃদয়ে দোলা দিবে, দৃশ্যপটে ভেসে উঠবে শুভ্র পাতায় লেখা কৃষ্ণ হরফের শব্দের গাঁথুনিতে গড়ে ওঠা কাহিনি। রবিউল করিম মৃদুল রচিত "জলমিছরি" বইটিও সেরকমই একটি উপলব্ধি বোধসম্পন্ন একটি উপন্যাস যা আমাকে কেবল রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাথেই পরিচয় করায়নি বরং আমাকে ভাসিয়ে নিয়েছিল গত হওয়া গ্রামীণ জীবনে। আমার শৈশবের বোধসম্পন্ন তিন বছর কাটে গ্রামে নানুবাড়িতে। ফলশ্রুতিতে গ্রামীণ আবহ আমাকে এখনও টানে। ইচ্ছে করে কংক্রিটের যান্ত্রিক কোলাহল থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছুটে যাই আমার স্নিগ্ধ গ্রামে। যেখানে ঘুঘুদহের মতো মেলা হবে, মাটির চুলায় রান্না হবে, বেতফল খাওয়া, আনন্দ করে বিলে বক ধরা ইত্যাদি। যদিও আমি বক ধরা দেখিনি, দেখেছিলাম ডাহুক ধরা তবুও হাফিজুলের সাথে আসাদ ও পরীর বক ধরার পটভূমি দৃশ্যায়নে লেখক এতটাই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন যে ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করলেই সবটা যেন ভেসে উঠছিল অক্ষিপটে। উপন্যাসের ভাষাশৈলী ছিল অনন্য। ঘটনার পাশাপাশি চরিত্রদের উপস্থাপন ও পারিপার্শ্বিকতা বর্ণনায় লেখক দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। এতে করে মনে হয়েছে উপন্যাসটি পাঠকের কাছে কেবল গলাধঃকরণের মতো উপভোগ্য, আনন্দসঞ্চারী না হয়ে উপলব্ধি বোধসম্পন্ন। ফলে উপন্যাসটি পাঠের সময় আমার পাঠক হৃদয় নিজেকে হারিয়েছে চরিত্রদের মাঝে যেন নিজেই উপস্থিত ছিলাম এই উপন্যাসে।
কথায় বলে, অর্থের দৈন্যদশায় ভালোবাসা হারিয়ে যায় জানালার ফাঁকা দিয়ে। কিন্তু সেই কথাকেই লেখক উপন্যাসে দুই চরিত্র দ্বারা উপস্থাপন করেছেন দুইভাবে; ইতিবাচক ও নেতিবাচক। ভালোবাসার সম্পর্কের কাছে কখনও কখনও হেরে যায় আর্থিক টানাপোড়েন আবার কখনও ভালোবাসা হেরে যায় আর্থিক প্রলোভনে। এই উপন্যাসের অন্যতম সেরা একটা চরিত্র ছিল এসাক ডাকাত। প্রথম থেকে তার প্রতি আমার একটা ক্ষুব্ধ মনোভাব থাকলেও একসময় তার সাহসী পদক্ষেপ আমাকে মুগ্ধ করে সে-ই হয়ে উঠে আমার কাছে গল্পের নায়ক। "জলমিছরি" উপন্যাসে যার কথা না বললেই নয় সে হলো চাঁনবিবি। তার পরম স্নেহ, পুত্রবধূর প্রতি উদারতা ছিল মুগ্ধ করার মতো।
শহুরে জটিলতার মতো গ্রামেও কিছু অসাধু মাতব্বর সম্প্রদায় থাকে যাদের অনৈতিক কার্যকলাপের স্বীকার হয় এসাকের মতো অনেক অসহায়। কিন্তু একসময় অনেকে ঠিক ঘুরে দাঁড়ায় নয়তো হারিয়ে যায় কালের আবর্তে।
যারা গ্রামীণ পটভূমির উপন্যাসে আগ্রহী তাদের জন্য চমৎকার এই বইটি সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক। বইটিতে আপনি আনন্দের উৎসই পাবেন তা নয় আপনি হয়তো ফিরে যাবেন আপনার ফেলে আসা অতীতে। কোনো ঘটনার সাথে মিল পেয়ে ভাববেন, কী ব্যাপার! এটা লেখক কী করে জানলেন? উপন্যাসের পরতে পরতে ছিল আকর্ষণ রুদ্ধশ্বাস তোলা কিছু ঘটনা, প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া যা সম্পূর্ণ উপন্যাসে পাঠককে ধরে রাখতে দারুণ সহায়ক। যখন একটু একঘেয়েমি আপনাকে ছাপিয়ে দিতে চাইবে তখনই দেখবেন লেখক উপন্যাসের মোড় এমনদিকে ঘুরিয়ে দিবেন যে আপনার একঘেয়েমি কেটে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করবে।
যদিও কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলেনি তবুও মুগ্ধতার রেশ থেকে উপন্যাসটিকে ৪.৫ রেটিং দিব।
সর্বশেষে লেখককে ধন্যবাদ জানাব এমন চমৎকার বইটি পাঠককে উপহার দেওয়ার জন্য এবং আদি ভাইকেও ধন্যবাদ জানাই যার মাধ্যমে উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
রবিউল করিম মৃদুল এর জলমিছরি এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 396.00 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। Jalmichri by Rabiul Karim Mridulis now available in boiferry for only 396.00 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.