সমাজের সৃষ্টি, পরিবর্তন, পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করতে গিয়ে চার প্রকার ঘটনা ও তার কার্যকারণ রীতি সনাক্ত করি। জড়ীয়, দ্রৌম, ঔপজ্ঞিক, কৃত্রিম। শিক্ষা, বিদ্যা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ধর্ম এই শব্দগুলির অর্থ খুঁজতে গিয়ে অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য পাই। তা হলাে—কৃত্রিম কার্যকারণ রীতি নির্ভরতা, সদা পরিবর্তনশীলতা ও নিরন্তর স্ফীতিমাতা। এই সব বৈশিষ্ট্যেরই আভাস ছিল আমার লেখা ‘ঋষি' (প্রকাশ১৯৯৮) নামক গ্রন্থে। তাতে অনেক কথা বলা হয়নি। দ্বিতীয় ঋষি’তে চেষ্টা করেছি সেই না-বলা কথাগুলি বলতে। সমাজ পরিবর্তনের সূত্র অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা একটি বৈজ্ঞানিক তত্ন পাই। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘ধারণতত্ত্ব বা আধারাধেয়তত্ত্ব। তত্ত্বটি হলাে : বিশ্বে নিরাধার বা নিরাধেয় বলে কিছু নেই। পরিবর্তন মানেই হলাে আধার বা আধেয়ের পরিবর্তন। অকৃত্রিমজগতের মতাে কৃত্রিমজগতেও এই পরিবর্তন একইভাবে ঘটে। কৃত্রিমজগতে নিরন্তর স্ফীতিমান শিক্ষা একের পর এক পুরনাে প্রথার বিলুপ্তি ঘটায়। তাতে নতুন নতুন মত-পথ তৈরি হয়, কিছু নড়বিশ্বাস বিলুপ্ত হয়, পুরনাে প্রযুক্তির জায়গায় নতুন প্রযুক্তি প্রতিস্থাপিত হয়। কার্যত এই সবই ঘটছে ধারণতত্ত্বের সুনির্দিষ্ট নিয়মে। বেলুনে বাতাস ঢুকাতে থাকলে সেটি হয় বাতাসের স্ফীতি। বাতাসের এই স্ফীতিতে এক সময়ে বেলুনটি ফেটে যায়, তাতে বেলুনের বাতাস সংকীর্ণ থেকে বিস্তীর্ণ আধারে চলে যায়। বর্তমান সমাজের পরিধি হচ্ছে বেলুনের রাবারের মতাে এবং শিক্ষা হচ্ছে বাতাসের মতাে। তত্ত্বে এই বেলুন সদৃশ সমাজটির নাম দেয়া হয়েছে গৃহতন্ত্র। শিক্ষার | নিরন্তর স্ফীতিতে সমাজটি কেবলই ফুলছে। অদ্য পর্যন্ত ধরে নিতে হবে যে, সমাজের ধারণ ক্ষমতা এখনাে প্রান্তিক পর্যায়ে যায়নি, তাই এখনাে সমাজের গৃহতান্ত্রিক অবয়ব টিকে আছে। কিন্তু ধারণতত্ত্বের নিয়ম তথা অনিবার্য পরিণতি অনুযায়ী আগামীতে শিক্ষার মহাস্ফীতিতে গৃহতন্ত্র বা রাষ্ট্রপ্রথা নামক অবয়বটি বিলুপ্ত হবে। অতঃপর আধুনিক পরাতান্ত্রিক সমাজ প্রবর্তিত হবে। ঋষিরা পরাতান্ত্রিক সমাজের নাম দিয়েছেন আশ্রম। আশ্রম মানে আশ্রয় বা আধার। আশ্রমের বিকশিত বা বৃহৎ অবস্থার নাম চতুরাশ্রম। সমাজের ঘটনার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এই কারণেই চিন্তার ইতিহাসে ভাষাদর্শনের জন্ম হয়েছে। পাশ্চাত্য ভাষাদর্শনে ব্যাকরণের প্রাধান্য নেই, উপমহাদেশীয় ভাষাদর্শন অনুশীলনে ব্যাকরণ থাকে চালকের আসনে। পৃথিবীর প্রথম ভাষাবিজ্ঞানী পাণিনি সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের জনক। তাঁর গ্রন্থে স্বরধ্বনি, ব্যঞ্জনধ্বনি, বর্গ ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়েছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে। এই প্রকার ব্যাকরণিক বিজ্ঞান উপমহাদেশীয় ভাষাগুলি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনাে ভাষায় নেই। ঋষিরা প্রথমত কবি, দ্বিতীয়ত ভাষাদার্শনিক। তাদের মূল কথা, ‘যত বাক্য তত কর্তা। বহুকর্তা মানে বহুদেবতা বা বহুঈশ্বর। বাক্যের ক্রিয়া মানে ঘটনা। সেই ঘটনায় যুক্ত থাকে কারকসমূহ। ঋষিরা রূপকথাকে বলেছেন রূপক, যা কাব্যের একটি অলংকার। ঋষিকাব্যের রূপক আর পাশ্চাত্যের ইউটোপিয়া অভিন্নার্থক। লেখকের মনে ইউটোপিয়ার যে বৃহৎ অর্থটি লুকিয়ে থাকে সেটি অভিধানে থাকে । রূপক বা ইউটোপিয়ার কাল্পনিক হার্দ হচ্ছে-শিক্ষার স্ফীতিতে পৃথিবী একদিন অসুন্দর থেকে সুন্দর হবে, মানুষ একদিন নিকৃষ্ট থেকে উস্কৃষ্ট হবে। ঋষি পরিভাষায় সেই সুন্দর পৃথিবীর নাম স্বর্গ এবং সেই উৎকৃষ্ট মানুষের নাম ঈশ্বর। বিজ্ঞানের মুখােশ পরে বহু লেখক প্রগতির অভিনয় করেন। তাঁদের লেখায় রূপক ও রূপকথার পার্থক্য অনুপস্থিত। ধর্ম ও রিলিজিয়নকে সমার্থক ধরে মুখােশীরা একটি গৎ তৈরি করেছেন। সেই গৎটি মুখস্থ করলেই যেন লেখালেখি করা যায়, প্রগতিবাদী হওয়া যায়। ধারণতত্ত্বে ধর্ম হচ্ছে সংস্কৃতির ধারা যাতে নড়বিশ্বাস যুক্ত আছে। ভাষাদর্শন মােতাবেক ঋষিবাদ, ধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, বিদ্যা, নড়বিশ্বাস অভিন্ন। অপর পক্ষে রিলিজিয়ন হচ্ছে অনড়বিশ্বাস, যার আধার পবিত্রগ্রন্থ। মুখােশীরা গভিত্তিক চিন্তায় ধর্ম ও রিলিজিয়নকে একার্থক ধরে গুলিয়ে ফেলেন। ধর্মের অন্য নাম ধারণতত্ত্ব। এই গবেষণা শুরু হয়েছে ঋষিদের ধ্যান থেকে। তত্ত্বটি বৈদিকগ্রন্থ আছে হার্দ আকারে। ধারণতত্ত্বটি আমি বেদ থেকে নিয়েছি, তা নয়। আসলে বৈদিক নির্যাসের সঙ্গে আমার চিন্তাটি মিলে গেছে। কয়েক সহস্র বছর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ চিন্তকগণ এমন বিষয়ে গবেষণা করেছেন—ভাবতে গিয়ে তাদের প্রতি খুব শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করে। মনে হলাে তাদের নামেই বইটির নামকরণ করি। এই ইচ্ছেতেই ‘প্রথম ঋষি’ লিখেছিলাম এবং একই ইচ্ছেতেই ‘দ্বিতীয় ঋষি’ লিখলাম।
মঙ্গলচন্দ্র মন্ডল এর দ্বিতীয় ঋষি এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 255.00 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। Dwiteeya Rishi by Mongolchandra Mondolis now available in boiferry for only 255.00 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.