অতি সামান্য অবস্থা থেকে তিনি জীবনে উন্নতিসাধন করেছিলেন। সেই উত্থানের গল্প উপন্যাসের মতােই চমকপ্রদ। তাঁর পিতা আমির তুরগে বারলাস তুর্কিদের গুরখান গােত্রের প্রধান ছিলেন। তৈমুর লঙ ছােটবেলা থেকেই ছিলেন তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন দুর্ধর্ষ যােদ্ধা। যুবক বয়সেই তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী আমির ও সর্দারদের পরাজিত করে সমগ্র তুর্কিস্থানে একচ্ছত্র প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেশজয়ে বের হন। সুসংগঠিত সৈন্যবাহিনী, সেনা-পরিচালনার দক্ষতা, দুঃসাহসী বীরত্ব, রাজ্যজয়ের অদম্য স্পৃহা মানব-ইতিহাসে তৈমুরকে বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে। তৈমুরের ভাগ্যে পরাজয়ের লিখন ছিল না। নির্বিচার ধ্বংস, হত্যাযজ্ঞ ও বিভীষিকার আতঙ্ক ছড়াতে ছড়াতে তিনি এক দেশ থেকে অন্য দেশে পরিব্রাজন করেছেন। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন মধ্য-এশিয়ায়। তাঁর গৌরবময় পদচিহ্ন ও দুঃস্বপ্নময় স্মৃতির রক্তাক্ত ছাপচিত্র এঁকেছেন তিনি পারস্য ও মেসােপটেমিয়ার পথে পথে, রাশিয়া জর্জিয়া এশিয়া মাইনরে, সাইবেরিয়ার হিমশীতল তুষাররাজ্যে, আজারবাইজান, কুর্দিস্তান, আফগানিস্তান আর ইউফ্রেতিস-এর তীরবর্তী অঞ্চলে, এমনকি ভারতবর্ষের দিল্লি পর্যন্ত তৈমুরের আগ্রাসী থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। দিল্লির শাসক সুলতান মাহমুদ তােঘলককে। তিনি পরাজিত করেন। স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা না করে প্রচুর ধনরত্নসহ তিনি ফিরে যান। সর্বত্রই তিনি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, প্রবল প্রতাপান্বিত। যে-পথ দিয়েই গেছেন সেখানেই উড়েছে তার বিজয়ধ্বজ। তার যুদ্ধনৈপুণ্য ও রণকৌশল আজও বিস্মিত করে সকলকে। চেঙ্গিস খান ও মােঙ্গলদের ঐতিহ্য ও কীর্তিকে তিনি ধারণ করেছিলেন। সৈন্যদলকে তৈমুর পরিচালনা করতেন দলবদ্ধভাবে। ক্ষুদ্র দলের নেতৃত্বে যারা থাকতেন তাদের সকলকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন কেন্দ্রীয়ভাবে। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সূক্ষ্মবুদ্ধির অধিকারী। তৈমুর লঙ জন্মগ্রহণ করেন ১৩৩৬ সালের ৮ এপ্রিল। সমরখন্দের শাসক হিসেবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ১৩৬৯ সালে। ১৩৭৩ সালে তিনি দেশবিজয়ে বের হন। আমুদরিয়া পেরিয়ে প্রথমেই রাশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু হয় তাঁর। ১৪০৫ সালে মত্যর আগ পর্যন্ত তিনি ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, চীন ও ভারতের কিয়দংশ দখল করেন।
ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তৈমুরের বর্ণিল জীবনের কিয়দংশই আমরা পেয়ে থাকি। তৈমুর লঙের পূর্ণাঙ্গ কাহিনী জানার জন্য ইতিহাসের উপাদান আমাদের হাতে খুব কমই রয়েছে। ইতিহাসে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ভয়ঙ্কর, নিষ্ঠুর একজন মানুষ হিসেবে। কিন্তু এটা সর্বৈব সত্য নয়। শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তাঁর উদার পৃষ্ঠপােষকতায় রাজধানী সমরখন্দ শিল্পসাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার বিখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত হয়। মধ্য-এশিয়ার স্থাপত্যশিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। রাজপ্রাসাদ, বড় বড় ভবন ও মসজিদনির্মাণে তিনি আনন্দ পেতেন। যুদ্ধ করতে যেখানেই যেতেন সেখান থেকেই স্থপতি, শিল্পী ও মিস্ত্রিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি রাজধানীতে ফিরে আসতেন। . তৈমুর লঙকে নিয়ে অনেক গল্প, কবিতা, নাটক রচিত হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের সত্য উঘাটনের চেষ্টা হয়েছে কমই। পরাজিত জাতিরা তৈমুরের বীভৎস চিত্র অঙ্কনেই বরাবর উৎসাহ প্রদর্শন করেছে। কিন্তু যে-মানুষটি একক যােগ্যতায় বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি কি শুধুই ধ্বংস ও হত্যার প্রতীক হতে পারেন? তৈমুর লেখাপড়া জানতেন না। সঙ্গত কারণেই ইতিহাসের গ্রন্থ রচনায় তিনি আগ্রহী ছিলেন না। জাফরনামা' নামে তাঁর বিজয়কাহিনী নিয়ে একটি ফারসি গ্রন্থ আছে। ১৬শ শতকে ক্রিস্টোফার মারলাের নাটক ট্যামবারলেইন' থেকে তৈমুরের বিভিন্ন রাজ্যজয়ের লােমহর্ষক পরিচয় পাওয়া যায়। ১৪শ শতাব্দীর শেষদিকে দামেস্কাসের ইতিহাসবেত্তা ইবনে আরব শাহ তৈমুরের জীবনী রচনা করেন। ১৯০৬ সালে জে. এইচ. স্যান্ডার্স বইটির অনুবাদ করেন। তৈমুর লঙের বস্তুনিষ্ঠ ও অনবদ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন হ্যারল্ড ল্যাম্ব। সেই বইটির অনুবাদের নতুন সংস্করণ হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে। হ্যারল্ড ল্যাম্ব আমেরিকার একজন ঐতিহাসিক। আরবভূমিতে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে তৈমুর সম্পর্কে অনেক উপাদান সংগ্রহ করেন। মধ্য-এশিয়ার পথে-প্রান্তরে ভ্রমণ করে বিভিন্ন যাযাবর জাতির অতীত ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তারই একটি হচ্ছে দিগ্বিজয়ী তৈমুর। হ্যারল্ড ল্যাম্ব এ ছাড়াও চেঙ্গিস খান, নূরমহল ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করে ঐতিহাসিক উপন্যাসকার হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। হ্যারল্ড ল্যাম্ব দিগ্বিজয়ী তৈমুর বইটি রচনা করেন ১৯২৮ সালে। বইটি তখনই ব্যাপক সাড়া জাগায় মার্কিন সাহিত্যে। বিখ্যাত সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন বইটির স্বচ্ছন্দ ও প্রাঞ্জল অনুবাদ করেন ১৯৬৫ সালে। বাংলায় বইটি প্রকাশিত হয় ঢাকাস্থ ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রােগ্রামস-এর সহযােগিতায়। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এরকম একটি চিত্তাকর্ষক, উদ্দীপক ও প্রেরণাসঞ্চারী সুহৃদ গ্রন্থ দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত অবস্থায় নেই। আজকের ইতিহাস-উৎসাহী পাঠকদের জন্যেই মূলত নতুন করে বইটি প্রকাশ করা হল।
হ্যারল্ড ল্যাম্ব এর দিগ্বিজয়ী তৈমুর এখন পাচ্ছেন বইফেরীতে মাত্র 176.00 টাকায়। এছাড়া বইটির ইবুক ভার্শন পড়তে পারবেন বইফেরীতে। digaijoey tomur by Harold Lambis now available in boiferry for only 176.00 TK. You can also read the e-book version of this book in boiferry.