আমি হযরত হাফেজ্জী হুজুরকে দেখেছি। দেখেছি তার নূরে ভরা চেহারা, গম্ভীর চলাফেরা, উদাস উদাস চাউনী। দেখেছি তার সদা তিরতির করে কাপতে থাকা ওষ্ঠাধর, যেখানে অবিরাম গুঞ্জরিত হত কুরআন তিলাওয়াত আর আগ্লাহর মহিমা ও গুণকীর্তন। দেখেছি তাঁর ললাটের সেই ঝলমলে গােলাকার দাগ, যা অত্যধিক সেজদার কারণে জ্যোর্তিময় মনে হত। দেখেছি তার তাসবীহ হাতে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাওয়ার অনুপম দৃশ্য।

আমি শুনেছি তাঁর নূরে ভরা কথা। যে কথায় আপ্লুত হত হৃদয়। উজ্জীবিত হত মন। অশ্র সজল হত নয়ন। যে কথা শােনার জন্য চাতক পাখির পিয়াসা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসত জ্ঞানীগুণী, শিক্ষিত, সম্রাক্ত আর বহু মানুষ। আসত প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে, মাদরাসা-ই-নূরিয়ার মসজিদে। মাগরিবের নামাযের পর দরূদ শরীফের খতম হত। হুজুর তখন আওয়াবীনের নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। আহ কী চমৎকার সেই নামায! কী মনােমুগ্ধকর সেই রুকু-সেজদা! আল্লাহর সামনে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার সে কী দুর্লভ আকুতি! তা কি কখনাে ভােলা যায়! তা কি কখনাে হৃদয় থেকে হারিয়ে যায়!! তারপর হযরত বয়ান করতেন। মধুমাখা তার কথা। মায়ায় ভরা তাঁর বয়ান। উপমায় সাজানাে তার উপদেশ। সে বয়ান চলাকালে তাঁর মােলায়েম পা দাবিয়ে দেয়ার খােশকিসমত আমার হয়েছে। তাঁর হুইল চেয়ার চালিয়ে নেয়ার সৌভাগ্যও আমার মাঝে মাঝে হয়েছে। এরপর তাঁর জীবনে এল আরেক অধ্যায়। তা ছিল দারুণ বিস্ময়কর। যার প্রতিটি বাঁক ছিল চমকে ভরা। শিহরণে টইটম্বুর। তখন আমি কাফিয়ার জামাতে পড়ি। মসজিদ-মাদরাসা আর খানকার গণ্ডি পেরিয়ে তিনি হাজির হলেন এক পিচ্ছিল অঙ্গনে। রাজনীতির ময়দানে। দিলেন তওবার ডাক। সেই ডাকে আলােড়িত হল গােটা দেশের আপামর জনতা। জেগে উঠল চিত্তাশীল মানুষের মন। উজ্জীবিত হল আলেম-ওলামার প্রত্যয়। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার প্রত্যাশায় টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায় উচ্চকিত হল তাকবীর ধ্বনি। কেঁপে উঠল বাংলাদেশ। ছুটে এল লাখাে মানুষ হেরার রাজ তােরণের দিকে।
দেখেছি তার ৮১ আর ৮৬ -র রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সকাল-সন্ধ্যা মাইকিং করেছি ঢাকার পথে প্রান্তরে। অলিতে গণিতে। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে সন্ধ্যায় ফিরে এসেছি নূরিয়ায়। রাতে অপূর্ব শিহরণ নিয়ে বিবিসির সংবাদ শুনেছি। সে ছিল এক বর্ণিল স্বপ্নের দেশে হারিয়ে যাওয়া।